‘আমার জন্য আপনেরা দোয়া করবেন’
‘মুক্তামণির সুস্থতার জন্য আমরা সবাই যুদ্ধ করছি। অকারণে প্রবেশ করে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়াবেন না।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের ছয়তলার কেবিন ব্লকের ৬০৮(এ) ও ৬০৮(বি) কেবিনের গেটের সামনে দাঁড়াতেই বড় বড় হরফে সতর্কতামূলক এ লেখাটি চোখে পড়ে।
সাইনবোর্ডের ওপরে ইংরেজি সবুজ হরফে ছোট্ট করে লেখা নাম মুক্তামণি, গ্রিন ইউনিট। গত সাড়ে পাঁচ মাসেরও বেশি সময় যাবত এ লেখাটি ঝুলছে। তবে আগামীকাল (শুক্রবার) থেকে মাসখানেকের জন্য হয়তো সতর্কতামূলক এ লেখাটি থাকবে না। কারণ রাত পোহালেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছে বহুল আলোচিত মুক্তামণি।
বৃহস্পতিবার, রাত ৯টা। দুই-তিনবার টোকা দিতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন মুক্তামণির বাবা ইব্রাহিম হোসেন। তার বগলে এক গাদা চিকিৎসার কাগজপত্র। সালাম বিনিময় করে কক্ষে বসার অনুরোধ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে ছুটলেন।
যাওয়ার সময় জানালেন, সকালেই ভাড়া করা গাড়িতে সাতক্ষীরার উদ্দেশে হাসপাতাল ছাড়বেন। তাই শেষবারের মতো ডাক্তারের কাছ থেকে মেয়ের চিকিৎসা অর্থাৎ ওষুধপত্র বুঝে নিচ্ছেন।
কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখা যায় পশ্চিম পাশের বেডে কয়েকটি বালিশ উঁচু করে মুক্তামণি হেলান দিয়ে বসে আছে। বিপরীত দিকের বেডে মুক্তামণির ছোট্ট ভাইটি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। শিয়রে বসে হাতে গ্লাভস পরছিলেন মুক্তামণির মা আসমা বেগম। গ্লাভস পরে মেয়ের শয্যাপাশে বসে পরমস্নেহে মেয়ের পিঠে হাত বুলাতে শুরু করলেন।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানালেন, মেয়েটার সারা শরীর চুলকায়। তাই কিছুক্ষণ পরপর শরীরের বিভিন্ন স্থানে চুলকিয়ে দিলে আরাম পায়।
বাড়ি ফিরে যাওয়া প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি জানান, ১৬ ডিসেম্বরের আগেই চিকিৎসকরা রিলিজ দেয়ার কথা জানিয়েছিলেন। সেই থেকে মুক্তামণি বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। কিন্তু দিন দশেক আগে হাতের ব্যান্ডেজ খুলে দেয়ার সময় ১৬ ডিসেম্বরের আগে বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না জানানো হলে মুক্তামণির মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।
কিন্তু গত দুদিন আগে বার্ন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, ডা. সামন্ত লাল সেনসহ অন্য চিকিৎসকরা ২২ ডিসেম্বর এক মাসের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিলে সেই দিন থেকে মুক্তামণির চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক দেখা যায়। সেদিন থেকেই সে কাপড়-চোপড় গোছাতে শুরু করে।
আসমা বেগম জানান, জুলাই মাসের ১১ তারিখ থেকে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে-বসে মুক্তামণির সময় কাটছে। এ সময়ে ছয়বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। তিনি জানান, মেয়েটি রাতে ঘুমাতে পারে না। রাতে ১০ থেকে ১২ বার তাকে বা তার বাবাকে ডেকে শরীরের বিভিন্ন স্থান চুলকিয়ে দিতে কিংবা টিপে দিতে বলে। ভারী হাতের কারণে একদিকে কাত হয়ে থাকতে থাকতে শরীর ব্যথা হয়ে যায়।
ইব্রাহিম হোসেন জানান, বার্ন চিকিৎসকরা গাড়ি ভাড়া করতে ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র বুঝিয়ে দিয়েছেন। বাড়ি গিয়ে দুদিন পর পর দুই-তিন ঘণ্টার জন্য ব্যান্ডেজ খুলে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। এক মাস বাড়ি থাকার সময় মুক্তামণির মা ড্রেসিং করবে বলে জানান।
মুক্তামণির মা বলেন, আজ মেয়েটি বারবার ঘড়িতে কয়টা বাজে জানতে চাইছে। রাত পোহালেই বাড়ি ফিরতে রওনা হবে এ খুশিতে বারবার সময় জিজ্ঞাসা করছে। অন্যান্য দিন মোবাইলে গেমস খেলে সময় কাটালেও আজ কাপড়-চোপড় গোছানোর কাজে তাকে সহায়তা করেছে।
মুক্তামণির সঙ্গে কথা বলার সময় পাশের বেডে বসেছিলেন হাসপাতালের লিফটম্যান। তিনি জানালেন, গত কয়েকমাসে মেয়েটির জন্য মায়া পড়ে গেছে। এক মাসের জন্য বাড়ি ফিরে যাচ্ছে তাই শেষবারের মতো দেখা করতে এসেছেন।
কথাবার্তা বলে চলে আসার সময় মুক্তামণি বলে ওঠে, আমার জন্য আপনেরা দোয়া করবেন। বাড়ি গিয়া যেন ভালো থাকি। এক মাস পর আবার হাসপাতালে আসমু।
বিরল চর্মরোগে আক্রান্ত সাতক্ষীরার শিশু মুক্তাকে নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। গত ৯ জুলাই জাগো নিউজে ‘লুকিয়ে রাখতে হয় মুক্তাকে’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর মুক্তার চিকিৎসা দেয়ার দায়িত্ব নেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তার যাবতীয় চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব নেন। গত ১১ জুলাই মুক্তামণিকে ঢামেকে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে কয়েক দফায় তার দেহে অস্ত্রোপচার হয়।
এমইউ/বিএ