বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বাস্তবায়ন জরুরি
‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ছাড়া লাখ লাখ মামলার জট কমানো সম্ভব নয়। কানাডা, ইংল্যান্ডে এভাবেই বেশির ভাগ মামলার নিষ্পত্তি হয়’ বলে মন্তব্য করেছেন ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং সাবেক এ আইনমন্ত্রীর সঙ্গে নিম্ন আদালতের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রসঙ্গে সম্প্রতি মুখোমুখি হয় জাগো নিউজ।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় এ গেজেট বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে মত দেন তিনি। সমালোচনা করেন গেজেটের সমালোচকদের। আলোচনায় উঠে আসে বিচার ব্যবস্থার অন্য প্রসঙ্গও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজ’র জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষ পর্ব-
জাগো নিউজ : নিম্ন আদালতের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। বিষয়টি ‘রাজনৈতিক’ আখ্যা দিয়েছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ।
শফিক আহমেদ : আমি মনে করছি, এ গেজেট নিয়ে সংশয় প্রকাশের কিছু নেই।
জাগো নিউজ : সরকার পরিবর্তন হলে এর কী প্রভাব থাকতে পারে?
শফিক আহমেদ : এখন যারা এর সমালোচনা করছেন তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সমালোচনা করছেন। সমস্ত আইন পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পরিমার্জন হয়ে থাকে। কোনো বিশেষ বিষয়ে যদি অসঙ্গতি হয়, তাহলে তারা স্পষ্ট করে বলতে পারেন যে, মাসদার হোসেন মামলার রায় এখানে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আদালত তখন সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু ঢালাওভাবে সুপ্রিম কোর্টকে যেভাবে নির্বাহী বিভাগের অধীন বলা হলো, তা সঠিক নয়।
বিএনপি কেন এ গেজেটকে রাজনৈতিক আঘাত বলছে, আমার জানা নেই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ বিধির প্রণয়ন নয়।
দ্বিতীয়ত, আইনমন্ত্রী আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং করেছেন এ বিষয়ে। সুপ্রিম কার্টের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে মনে করি।
জাগো নিউজ : অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলছেন, সাবেক বিচারপতি এস কে সিনহা শৃঙ্খলাবিধি সম্পূর্ণভাবে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে নিতে চেয়েছিলেন, যা সংবিধান পরিপন্থী। তার মানে সুপ্রিম কোর্টের চেষ্টা তো ছিল আলাদা করার, যা সরকার রোধ করলো?
শফিক আহমেদ : সংবিধানের পরিপন্থী কোনো বিধান সরকার করতে পারে না। সবার আগে সংবিধানকেই গুরুত্ব দিতে হয়। যারা সমালোচনা করছেন, তারা না জেনেই করছেন।
জাগো নিউজ : বিষয়টি এমন কি-না, এস কে সিনহা দায়িত্ব থাকার কারণেই গেজেট প্রকাশে সরকার গড়িমসি করেছে?
শফিক আহমেদ : প্রধান বিচারপতি এককভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের সিদ্ধান্তও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা যতটুকু শুনেছি, এস কে সিনহা এককভাবেই সকল সিদ্ধান্ত নিতে চাইতেন।
জাগো নিউজ : বাধা কি তাহলে তিনিই ছিলেন?
শফিক আহমেদ : আইনমন্ত্রী বলেছেন, বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি প্রকাশে এস কে সিনহা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
জাগো নিউজ : আপনার কাছে এর ব্যাখ্যা কী?
শফিক আহমেদ : আমার কাছে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। এস কে সিনহার সঙ্গে আমার কথা হয়নি এ ব্যাপারে। আবার আইনমন্ত্রী কেন এমন মন্তব্য করেছেন, তা আমি বলতে পারবো না।
জাগো নিউজ : যে গেজেট প্রকাশ হয়েছে, এস কে সিনহা থাকলে এমনটি হতো না...
শফিক আহমেদ : এস কে সিনহা তো একা নন। আপিল বিভাগে আরো বিচারপতি আছেন।
জাগো নিউজ : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে এস কে সিনহা সচেষ্ট ছিলেন বলে বিভিন্ন মহলে প্রচার রয়েছে। এমনকি নিম্ন আদালতের শৃঙ্খলাবিধির ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছিলেন বারবার…
শফিক আহমেদ : এস কে সিনহা পাবলিক প্লেসে কথা বলে বিচার বিভাগের মান ক্ষুণ্ন করেছেন বলে মনে করি। কোনো দেশের প্রধান বিচারপতি এভাবে জনসম্মুখে বলেননি যে, সরকার আমার ক্ষমতা কেড়ে নিতে চায়।
জাগো নিউজ : সমস্যা থেকে এমনটি বলা যেতেই পারে? জনগণই তো রাষ্ট্রের মালিক…
শফিক আহমেদ : না। এমন সমস্যা হয়নি। তিনি আগ বাড়িয়ে মিডিয়ায় কথা বলতেন। ভারতে সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে মিডিয়া যেতেই পারে না। তিনি পাকিস্তানের বিচার বিভাগের উদাহরণ দিয়ে সরকারকে ভয় দেখালেন। মিডিয়ায় ফলাও করে তা প্রকাশ হলো।
জাগো নিউজ : এসব ঘটনায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হলো কিনা?
শফিক আহমেদ : না। আমি তা মনে করি না। কোনো অবস্থাতেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়নি।
জাগো নিউজ : বিচার বিভাগের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কী বলবেন?
শফিক আহমেদ : বিচার ব্যবস্থার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে হলে মামলার জট নিয়ে সবার আগে কথা বলতে হবে। মিডিয়া এ বিষয়ের ওপর আরো গুরুত্ব দিতে পারে। নিম্ন আদালতের শৃঙ্খলা জরুরি। তবে আরো জরুরি হচ্ছে লাখ লাখ মামলার দ্রæত নিষ্পত্তি। ২০ বছর ধরে একটি মামলার শুনানি চলে। কেনো? মানুষকে এ হয়রানি থেকে মুক্তি দিতে বিচারকরা কার্যত কী করছেন? বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বাস্তবায়ন জরুরি।
জাগো নিউজ : আসলে জটিলতা কোথায়?
শফিক আহমেদ : মিডিয়া অনুসন্ধান করতে পারে। আসলে কী হচ্ছে? সকাল ১০টাতেও অনেক বিচারক এজলাসে বসেন না। অনেকে বৃহস্পতিবার অফিস করে ঢাকায় চলে আসেন। আর রোববার দুপুর ১২টায় গিয়ে অফিসে বসেন। একটি মামলার শুনানি শতবার মুলতবি করা হয়।
জাগো নিউজ : আপনিও আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। কী উদ্যোগ নিয়েছিলেন মামলার জট কমাতে?
শফিক আহমেদ : আইন মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিলেই তো মিডিয়া লিখবে নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করছে।
দেশের মানুষ আসলে বিচার বিভাগের কাছে কী চায়? একটি বিষয়ে বিরোধ হয়েছে, আদালতের মাধ্যমে তার নিষ্পত্তি চায়। কিন্তু আদালতে গিয়ে যদি ১০ বছর সময় লাগে নিষ্পত্তির, তাহলে মানুষের আস্থা থাকবে কী করে? আস্থা-অনাস্থার বিষয় হচ্ছে এখানেই।
জাগো নিউজ : আপনার পরামর্শ কী?
শফিক আহমেদ : আমি মনে করি, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ছাড়া লাখ লাখ মামলার জট কমানো সম্ভব নয়। কানাডা, ইংল্যান্ডে এভাবেই বেশির ভাগ মামলার নিষ্পত্তি হয়।
থানায় বসেও অধিকাংশ মামলার নিষ্পত্তি হতে পারে। আদালতে মামলা হলে সামাজিক বিরোধ আরো বাড়ে।
জাগো নিউজ : আস্থার ব্যাপার থেকে মানুষ আদালতে যায়। পুলিশকে পক্ষ করতে অনাস্থার ব্যাপার থাকে...
শফিক আহমেদ : বাটোয়ারা মামলা ৩০ বছরেও নিষ্পত্তি হয় না। এখানে পুলিশকে দায়িত্ব নিতে হবে, এমন নয়। উভয় পক্ষের আইনজীবী মিলে ভালো একটা সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
জাগো নিউজ : আপনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন এ ব্যাপারে। এখন কী অবস্থায় আছে?
শফিক আহমেদ : আমি আইন করে দিয়েছিলাম। তবে এখন কী অবস্থায় আছে, তা বলতে পারবো না। শতকরা ৮০ ভাগ মামলাই ঠুনকো অভিযোগের। মামলা চালাতে গিয়ে উভয়পক্ষই ফতুর। একটি মামলার কারণে আরো শত মামলা হয়। সামাজিক বা পারিবারিকভাবে এসব বিরোধ নিষ্পত্তি হলে উভয়ই উপকৃত হবেন বলে মনে করি। সমাজে শান্তি আসবে। তাহলে বিচারকরা গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর দ্রুত শুনানি করতে পারবেন।
জাগো নিউজ : আদালত দুর্বল মামলা আমলে না নিয়ে ফেরত দিতে পারেন?
শফিক আহমেদ : আদালতকে আসলে আমলে নিতেই হয়। এটি-ই বিধান। যদি বিকল্প ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে আমলে নেয়ার প্রয়োজন হতো না। নিম্ন আদালত বাতিল করলে আবার উচ্চ আদালতে আসছেন বাদী। অন্য ব্যবস্থা না থাকায় এভাবে হয়রানি হচ্ছেন মানুষ।
এএসএস/এমএআর/পিআর