সম্মুখযুদ্ধের দিন কখনও ভাবিনি বেঁচে থাকব

সিরাজুজ্জামান
সিরাজুজ্জামান সিরাজুজ্জামান , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:২২ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭

আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় বিদস। আমাদের গর্বের দিন। কিন্তু এই স্বাধীনতা আনতে গিয়ে আমাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। হাজার হাজার জীবন দিতে হয়েছে। সহ্য করতে হয়েছে অনেক নির্যাতন, অত্যাচার।

দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল জয়-পরাজয়ের সংগ্রামের লড়াইয়ে টিকে থাকার কিংবা বেঁচে থাকার সংগ্রাম, তা কখনও শক্রর আবার কখনও বা প্রকৃতির সঙ্গে।

এ সময় মানসপটে ভেসে আসছে ১৯৭১ সালের ২৪ আগস্ট চট্টগ্রামের কুমিরার সেই ভয়াবহ ঘটনার কথা। এ ঘটনার দুইদিন আগে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে সেক্টর কমান্ডার ওই অপারেশনের দায়িত্ব দেন আমাকে। আমি তখন ক্যাপ্টেন ছিলাম। কুমিল্লায় ৮০ থেকে ৯০ জন পাকিস্তানি সৈন্য ছিল। সেক্টর কমান্ডার বললেন, আক্রমণকালে আমাকে কামানের সাপোর্ট দিবেন। এই ধরনের একটি দায়িত্ব পেয়ে আমি খুব খুশি ছিলাম। আক্রমণের আগে লক্ষ্যবস্তুর ওপর প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের জন্য একটি ছোট্ট সেনাদল (রেকি গ্রুপ) তৈরি করলাম।

সেদিন সকাল নয়টায় লে. বদিউজ্জামান, সুবেদার চাঁন মিয়া, সুবেদার তৈয়ব, সুবেদার শফিউল্লাহ, নায়েক তাহের এবং সিপাহী হান্নান প্রমুখ এই গ্রুপে ছিল। ওইদিন সব ক'জন প্লাটুন কমান্ডারকে আমার সঙ্গে নিই। ভারতের মোহনপুর থেকে ধর্মঘর পর্যন্ত একটি ছোট্ট কাঁচা রাস্তা। একমাত্র হান্নান ছাড়া আমাদের সবার কাছে অস্ত্র ছিল। কিন্তু সেসব হালকা অস্ত্র ও মেশিনগান। আমার কাছে ছিল একটি চাইনিজ চীনা স্টেনগান। মাত্র ১৪ বছর বয়স ছিল হান্নানের। দেখতে ছোট খাট হলেও শক্ত সামর্থ্য। আমি তাকে একটি ময়লা গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট পরিয়ে রাখাল ছেলের মতো সাজিয়ে দিই। তৎকালীন কুমিল্লা জেলার অত্যন্ত নির্ভীক এই দেশপ্রেমিক কিশোর ছদ্মবেশে চারদিক নজর রেখে সামনে চলছিল।

পরে হান্নান খবর দিল সামনে পাঞ্জাবিরা অবস্থান করছে। তাই সতর্ক হয়ে ছোট্ট একটি পুকুরের পাড় দিয়ে যেই এগুনোর চেষ্টা করছি অমনি বজ্রপাতের মতো আমাদের দিকে মেশিনগান আর রাইফেলের গুলি আসতে শুরু করল। এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে মাটিতে পজিশন নিই আমরা। বুঝতে দেরি হল না যে আমরা শক্রর পাতা গোপন ফাঁদে পা দিয়েছি। মরিয়া হয়ে সবাইকে পাল্টা গুলি চালানো এবং এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিই। সৌভাগ্য বলতে হবে আমি যেখানে পজিশন নিই সেখানে একটি ছোট্ট গর্ত ছিল। গোলাগুলির মধ্যেই দ্রুত সেই গর্তে আশ্রয় নিই। গুলি ফুরিয়ে গেলে চরম সংকটের মুখে আমি, নায়েক তাহের ও সিপাহী হান্নান ছাড়া সবাই বিপজ্জনক দূরত্বের বাইরে চলে যায়। মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণের কারণে আমি মাথা তুলতে না পারলেও তাহেরকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিলাম। কারণ তার গুলির কভার নিয়ে আমি গর্ত থেকে সরে যাব। এরপর আমি কনুইয়ে ভর দিয়ে সরে যেতে শুরু করি। ক্রলিং করে বেরিয়ে আসার পরই ওই গর্তে একঝাঁক গুলি এসে পড়ে।

এরপর আমি একটি গাছের আড়ালে আশ্রয় নিই। সেখানে তাহের আগে থেকেই আশ্রয় নিয়েছিল। মেশিনগানের আঘাতে সেই গাছের বাকল ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। আমরা যেন শত্রুর জালে আটকা পড়েছি। এর মধ্যে আমাকে ক্যাপ্টেন সম্বোধন করায় শক্রপক্ষ জানল যে আমাদের দলে একজন ক্যাপ্টেন আছে। এ কারণে তারা আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম বা দিকে মাত্র দেড়ফুট উঁচু একটি জমির আইল। অবস্থা চরম সংকটাপন্ন দেখে কয়েক লাফে সেখানে কভার নিই এবং ক্রলিং করে ধীরে ধীরে শরীর টেনে খুব কষ্টে এগুতে শুরু করি। কিছুটা সংজ্ঞাহীনও ছিলাম।

এরপর মরিয়া হয়ে ওঠে দাঁড়ালাম, যা হওয়ার হবে। ক্রলিং আর করব না। তাই দেখে অন্যরা চিৎকার দিয়ে ওঠেন।
আমি তাহের ও হান্নানকে বললাম, আমার জন্য তোমরা ভেব না। নিজেরা বাঁচার চেষ্টা কর। প্রয়োজনে নিজের মাথায় নিজেই গুলি করব। তবুও শত্রুদের কাছে ধরা দেব না। তখন শত্রুদের সব মনযোগ আমার দিকে। এ সময় তাহের অবিরাম গুলি করে কভার দিয়ে চলে। এরপর প্রায় দেড়’শ গজ অতিক্রম করে একটি নিরাপদ স্থানে যাই আমি। আর এভাবেই আমরা একটি নিশ্চিত মৃত্যুর ফাঁদ থেকে বেঁচে যেতে সক্ষম হই।

আজ ভাবতেও অবাক লাগে সেদিন কীভাবে বেঁচে গেলাম! সেই সব দিনের কথা মনে হলে শরীর শিউরে ওঠে। আর গর্বে বুকটা ভরে যায় যে দেশের জন্য সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিতে পেরেছিলাম। এত জীবন, রক্ত, মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল এখন সবাই পেতে শুরু করেছে। মৃত্যুর আগে এটা তো দেখে যেতে চেয়েছিলাম আমরা। আমাদের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে দেখে আরও ভালো লাগে এখন। তবে স্বাধীনতার সুফল পেতে হলে সবাইকে দেশের জন্য কাজ করে যেতে হবে। গরিব দুঃখীদের মুখে হাসি ফুটাতে হলে আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে।

মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া এমপি
অনুলিখন: সিরাজুজ্জামান

এইচএস/ওআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।