আলোর মুখ দেখেনি কেজি স্কুল বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত
যত্রতত্র অনুমোদনহীন গড়ে ওঠা পাড়া-মহল্লা বা গ্রামের কিন্ডারগার্টেন স্কুল (কেজি) বন্ধের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এসব স্কুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) সমন্বয়ে ৫৫৯টি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
জেলায় জেলায় গড়ে ওঠা অবৈধ কেজি স্কুলের তথ্য সংগ্রহে গত এক বছর আগে এসব টিম গঠন হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ২২টি প্রতিবেদন জমা পড়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে চলতি মাসে ফের বৈঠকে বসবেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। জাগো নিউজের তিন পর্বের আনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কেজি স্কুলের বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। আজ থাকছে শেষ পর্ব।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বেসরকারি প্রাথমিক (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম) বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন যাচাই-বাছাই ও করণীয় বিষয়ে গত বছরের ১৬ আগস্ট একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এক মাসের মধ্যে মাঠ প্রশাসনকে এ বিষয়ে সুপারিশ পাঠানোর নির্দেশনা ছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ছাড়া কেউ কোনো তথ্য দেননি।
পরবর্তীতে এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশনা দিতে বলা হয়। নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ জানুয়ারি চিঠি দেয়া হয়। চিঠির পর সিরাজগঞ্জ, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, মাদারীপুর, লক্ষ্মীপুর, শরীয়তপুর, নাটোর, মানিকগঞ্জ, নোয়াখালী, ফরিদপুর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, কুষ্টিয়া, রংপুর, দিনাজপুর, কুমিল্লা, রাঙ্গামাটি, সিলেট, যশোর ও লালমনিরহাট ডিসিরা প্রতিবেদন জমা দেন।
প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করে জানা গেছে, কোন জেলায় কতটি স্কুল আছে অনেক ডিসি তা উল্লেখ করেননি। অনেক ডিসি দাবি করেছেন, তার জেলায় এ ধরনের স্কুল নেই। টাস্কফোর্সের কাছে স্কুলের বৈধতা যাচাই ও চালু রাখার প্রয়োজনীয়তা জানতে চাইলেও তা উল্লেখ করা হয়নি। স্কুলের ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার্থী ভর্তি, ফি নির্ধারণ ও আদায়, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, অবকাঠামো সুবিধাসহ নানা বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য চাওয়া হলেও তা দেয়া হয়নি।
স্কুলে কী ধরনের পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হয়, কারা স্কুল পরিচালনা করছেন, অর্থের উৎস কী, আদায়কৃত অর্থ কোথায় ব্যয় হয়, ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারি বিধিবিধান মানা হয় কিনা- এসব বিষয়ে জানতে চাইলেও প্রতিবেদনে কোনোকিছু উল্লেখ করা হয়নি।
ডিসিদের পাঠানো প্রতিবেদন ‘দায়সারা’- এমন মন্তব্য করে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নিজের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, করণীয় সম্পর্কেও সুস্পষ্ট মতামত দেননি ডিসিরা। এ কারণে অবৈধ স্কুলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি আটকে আছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও প্রতিবেদন পাঠানো যায়নি।
তিনি আরো বলেন, মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক অতিরিক্ত সচিব এ ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন। তিনি এলপিআরে যাওয়ার পরে ফাইলটি চাপা পড়ে যায়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অধিকাংশ কেজি স্কুল বৈধভাবে গড়ে ওঠেনি। সারাদেশে এসব স্কুলের সংখ্যা কত, স্কুলের পাঠ্যক্রম কী, সরকারি বই পড়ানো হয় কিনা, শিক্ষকদের যোগ্যতা, কী প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়, তাদের বেতনভাতা কত, কোন কোন খাতে অর্থ আদায় হয়, স্কুল প্রতিষ্ঠার অর্থের উৎস কী, আয়ের অর্থ কোথায় ব্যয় হয়, ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারি বিধিবিধান মানা হয় কিনা- এসব প্রশ্নের জবাবসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের পর সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।
সঠিক প্রতিবেদন পেতে ৪৮৭ উপজেলায় একটি, ৬৪ জেলায় একটি এবং আট বিভাগে একটি করে মোট ৫৫৯টি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। প্রতিটি টাস্কফোর্সের সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে টাস্কফোর্স কমিটি উপজেলার কেজি স্কুল নিয়ে কাজ করবে। জেলা প্রশাসক জেলা শহরের ভেতর বা উপজেলার বাইরে থাকা স্কুল এবং বিভাগীয় কমিশনাররা মহানগর বা মেট্রোপলিটন শহরের স্কুলের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করবেন বলে সরকারি নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়।
মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) সূত্র জানায়, কেজি স্কুলগুলো লাগামহীনভাবে চলছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বেসরকারি প্রকাশকদের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে শিশুদের ওপর বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষক আছেন যাদের ন্যূনতম যোগ্যতা নেই। নেই শিক্ষক হওয়ার প্রশিক্ষণও।
অনেক স্কুলের মালিক, স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে স্কুল পরিচালনা করছেন। সেখানে শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এসব স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টিউশন ফি আদায় করছেন। তবে শিক্ষকদের নামমাত্র বেতন-ভাতা দিচ্ছেন। এক কথায়, ‘রমরমা শিক্ষা বাণিজ্য’ চালাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান।
সীমাহীন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ১৯৬২ সালের স্কুল নিবন্ধন আইনের আলোকে ২০১১ সালে একটি বিধিমালা করে। কথা ছিল, কেজি স্কুলগুলো ওই বিধিমালার অধীনে নিবন্ধন করবে। কিন্তু ৬১৬টি স্কুল নিবন্ধন করে। আরো ৭৫১টি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অথচ কেজি স্কুলের বিভিন্ন সমিতির তথ্য মতে, সারাদেশে এ ধরনের অন্তত ৫০ হাজার স্কুল রয়েছে। মাঠ প্রশাসনের অবহেলার কারণে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান শুমারির পাশাপাশি কেজি স্কুলগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ থমকে গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এফ এম মঞ্জুর কাদের বলেন, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স্কুলগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। টাস্কফোর্সের পাঠানো প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা হচ্ছে। চলতি মাসেই আমরা এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে আবারো বৈঠকে বসবো।
তিনি আরো বলেন, যেসব জেলা থেকে কেজি স্কুল সংক্রান্ত তথ্য পাঠানো হয়েছে সেগুলোর আমরা মূল্যায়ন করবো। যেসব জেলা থেকে এখনো তথ্য পাঠানো হয়নি সেসব জেলা প্রশাসকদের পুনরায় তাগাদা দেয়া হবে। অবৈধ ও মানহীন স্কুল বন্ধের লক্ষ্য নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বলেও জানান তিনি।
এমএইচএম/এমএআর/এমএস