পদ্মা সেতুর প্রভাব : ৫ লাখের জমি কোটি টাকা

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:৩৭ এএম, ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭

স্বপ্নের পদ্মা সেতু ঘিরে চলমান প্রকল্পের আওতায় জাজিরা-শিমুলিয়া প্রান্তে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে পদ্মাপাড়ের মানুষের জীবনচিত্র। পদ্মাপাড়ের বাসিন্দাদের যে মাটি (জমি) এক সময় দুর্গম চরাঞ্চল ছিল, নামমাত্র টাকাতেই যা সহজে মালিকানা বদল হত, সেই মাটিই এখন যেন সোনার খনি।

বিপুল অংকের টাকাতেও এখন মিলছে না সেতু প্রকল্প এলাকা সংলগ্ন নাওডোবা ও পাঁচচর এলাকার জমি। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হওয়ার আগে যে জমির দাম ছিল বিঘাপ্রতি তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা, একই জমির দাম এখন বাড়তে বাড়তে কোটি টাকা ছুঁয়েছে। এমনকি, বাড়তি দামেও স্থানীয় বাসিন্দারা হাতছাড়া করতে চাচ্ছেন না তাদের জমি।

jagonews24

অবশ্য ‘সোনার চেয়ে দামি’ হয়ে ওঠা এসব জমি হাতছাড়াই বা করবেন কেন এ অঞ্চলের মানুষ। স্বপ্নের পদ্মা সেতু তাদের দেখাচ্ছে রঙিন স্বপ্ন। উত্তাল পদ্মার বুকে মাছ শিকার করে কিংবা জেগে ওঠা চরে ফসল ফলিয়ে যাদের জীবন চলত; তাদের অনেকেই এখন ঘাঁটি গাড়তে চাচ্ছেন বাপ-দাদার জমিতেই। পেশা পরিবর্তন করে ব্যবসায়ী বনে যাওয়ার স্বপ্ন বুনছেন তারা।

পদ্মা পাড়ের বাসিন্দাদের মত পদ্মা সেতু ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন আবাসন ব্যবসায়ীরাও। কেরানীগঞ্জের পর থেকে রাস্তার দু’পাশের জমিতে একের পর এক আবাসন ব্যবসায়ীদের পুঁতে রাখা সাইনবোর্ড- এখন সে খবরই জানান দিচ্ছে। দেখা গেলো আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, ধারিত্রী, পদ্মা ফিউচার পার্ক, মুক্তি আর্ট, জন্মভূমি, নতুন ধারা, প্রিয় প্রাঙ্গন, পুষ্পধারা, দখিনাচলসহ বিভিন্ন আবাসন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড শোভা পাচ্ছে রাস্তার দু’ধারে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয় বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। পদ্মা সেতু হবেই, সবার মধ্যে এই বিশ্বাস জোরদার হচ্ছে। আর সেতু হলে পদ্মাপাড়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জোরদার হবে; সেই বিশ্বাসও স্থানীয়দের মধ্যে জোরদার হচ্ছে। এর প্রভাবেই জমির দাম বেড়ে যাচ্ছে।

jagonews24

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, পদ্মা সেতু হলে ওই এলাকাতে (পদ্মা নদীর জাজিরা প্রান্তে) যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে, সেই প্রত্যাশার বিশ্বাস যোগ্যতা বেড়ে যাচ্ছে। কাজের যত অগ্রগতি বাড়বে মানুষের বিশ্বাস ততোই বাড়বে।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর কাজ যেহেতু এগিয়ে যাচ্ছে, তাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে। এ জন্য এখন থেকেই জমি কিনে রাখলে ভবিষ্যতে কর্মকাণ্ড বাড়লে এটি কাজে আসবে। সেই বিশ্বাস বড় হচ্ছে। পদ্মা সেতু হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবেই, এগুলো তারই ইঙ্গিত বহন করছে। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি শুভবার্তা বহন করছে।

jagonews24

সরেজমিনে সেতু অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, দু’টি পিলারের ওপর একটি স্প্যান বসে দৃশ্যমান হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আরও কয়েকটি পিলারের কাজ প্রায় শেষের পথে। জাজিরা প্রান্তের নাওডোবা থেকে পাঁচচর পর্যন্ত শেষ হয়েছে চারলেনের সড়ক। পদ্মার অপর পাড় শিমুলিয়া প্রান্তে চারলেনের সড়কের কাজ চলছে জোরশোরে। কেরানীগঞ্জের পর থেকে পদ্মা নদীর পাড় পর্যন্ত চারলেনের সড়কের মাটি ভরাটের কাজও প্রায় শেষের পথে।

শুধু চারলেনের সড়কই নয়, পদ্মা সেতুর কল্যাণে পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে চলবে ট্রেনও। এ জন্য হাতে নেয়া হয়েছে ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প’। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মু্ন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুরের ৮২ কিলোমিটার অংশ রয়েছে এই প্রকল্পের আওতায়।

প্রকল্পের আওতায় জমিও অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ট্রেন যোগাযোগের জন্য সাতটি রেলস্টেশন, ৩৪টি সেতু, ৯৬টি বক্স কালভার্ট এবং আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। এছাড়া বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীতে নৌ চলাচল অব্যাহত রাখতে ২১ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার উড়াল সংযোগ করা হবে।

jagonews24

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে একজন ব্যক্তি যেমন সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারেন, তেমনি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পণ্য পরিবহন করা সম্ভব। শরীয়তপুর ও মাদারীপুর অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না হলে মিল-কারখানা গড়ে উঠবে না। রাস্তা হয়ে গেলে এসব এলাকার মানুষ সকালে ঢাকা রওনা হয়ে বিকেল ফিরে আসতে পারবেন। পণ্য পরিবহন খরচ কমে যাবে। মধ্যসত্ত্বভোগী ফড়িয়াদের দৌরাত্ম কমে যাবে। ফড়িয়াদের কাছে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে হবে না, সরাসরি বাজারে প্রবেশের সুযোগ থাকবে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি মিল-কারখানা ব্যাপকভবে সৃষ্টি হবে। যারা বেকার আছেন, তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্ত গিয়ে দেখা যায়, যে স্থানটিতে সেতুর প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছে, তার থেকে অল্পদূরে গিয়েই সড়কে মিলিত হবে সেতু। যে সড়কে সেতু মিলিত হবে, সেই সড়কও ইতোমধ্যে চারলেনে রূপান্তর হয়েছে। নাওডোবা থেকে শুরু হয়ে চারলেনের সড়কটি সম্পূর্ণ দৃশ্যমান হয়েছে। চারলেনের এই সড়ক দিয়ে বর্তমানে গণপরিবহন চলাচল না করলেও স্থানীয় মোটরচালিত ভ্যান, প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল চলাচল করছে।

নাওডোবা এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা মধ্যবয়সী সখিনা বেগম বলেন, আগে এখান (যেখান দিয়ে চারলেনের সড়ক হয়েছে) দিয়ে যাতায়াতের কোনো রাস্তা ছিল না। এখানে ছিল খেত আর ডোবা। এখন পাকা রাস্তা হয়েছে, এই রাস্তা দিয়ে গাড়িও চলাচল করছে। পদ্মা সেতু হয়ে গেলে রাস্তা দিয়ে বড় বড় যানবাহন চলাচল করবে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হবে। কল-কারখানা গড়ে উঠবে। আমার ছেলে-মেয়রাও এর সুফল পাবে, সেই স্বপ্ন দেখছি।

jagonews24

তিনি বলেন, শেখের বেটি আমাদের ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা করছে। শুনছি আমাদের এলাকার ব্যাপক উন্নতি হবে। চারলেনের রাস্তা হওয়ায় ইতোমধ্যে আমরা অনেক সুবিধা পাচ্ছি। আগে পাঁচচরে আমাদের পায়ে হেঁটে যেতে হত। এখন খুব সহজেই পাঁচচরে যাওয়া যায়। সহজে মালামাল বহন করা যায়। আগে আমরা এক বিঘা জমি বিক্রি করেছি তিন লাখ টাকায়। এখন সেই জমি বিক্রি হচ্ছে ৩০ লাখ টাকার ওপরে।

পাঁচচর এলাকার বাসিন্দা মাইক্রোবাস চালক মো. ইব্রাহিম বলেন, আগে পাঁচচরের যে জমির দাম ছিল পাঁচ লাখ টাকা, সেই জমির দাম এখন এক কোটি টাকা হয়েছে। এই দামেও কেউ জমি বিক্রি করতে চাই না। কারণ সবাই জানে আমাদের অঞ্চলের ব্যাপক উন্নতি হবে। ঢাকার থেকে কোনো অংশে কম থাকবে না। আপনারা দেখেন, প্রধানমন্ত্রী এই অঞ্চলকে কী হিসেবে গড়ে তোলেন; মিল, কল-কারখানা সবকিছুই হবে এখানে।

এমএএস/এসআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।