বেতন নিয়ে ডিএসইতে তুঘলকি কাণ্ড

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:৪৫ পিএম, ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭

কারও বেতন এক লাফে বেড়েছে ৮০ শতাংশের ওপরে। কেউ কেউ আট বছরেও পদোন্নতি পাননি। কেউ আবার নিজের চুক্তিভিত্তিক চাকরিটাকে স্থায়ী করে নিয়েছেন। এ চিত্র দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই)। এমন বেতন আর পদোন্নতির বৈষম্যের কারণে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

বৈষম্যের শিকার ডিএসইর প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর সঙ্গে তর্কেও লিপ্ত হয়েছেন এক কর্মকর্তা। ফৌজিয়া সিদ্দিক নামের ওই নারী কর্মকর্তা ২৬ মিনিট ধরে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় করেন, যার অধিকাংশই ছিল বৈষম্যে বিষয়ে সিএফওকে উদ্দেশ্য করে নানা প্রশ্ন।

তবে ওই কর্মকর্তা একের পর এক প্রশ্ন করে গেলেও তার উত্তর দিতে ব্যর্থ হন আব্দুল মতিন পাটোয়ারী। গত ২ নভেম্বর মতিন পাটোয়ারী ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এ ঘটনা ঘটে। ওই তর্কের অডিও ইতোমধ্যে ইউটিউবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

ডিএসইর একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, নিয়ম অনুযায়ী ডিএসইর স্থায়ী কর্মকর্তাদের বছরে মোট বেতন বাড়বে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ। কিন্তু সম্প্রতি দুজন কর্মকর্তার বেতন ৮০ শতাংশের ওপর বাড়ানো হয়েছে। আবার সিএফও এবং প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তার (সিটিও) চাকরি চুক্তিভিত্তিক হলেও তারা তা স্থায়ী করে নিয়েছেন। কতিপয় কর্মকর্তা এমন বাড়তি সুযোগ-সুবিধা নিলেও খরচ কমানোর জন্য ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইন লঙ্ঘন করে কর্মকর্তাদের বেতন কাঠামো ভেঙে দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কে এ এম মাজেদুর রহমান এবং সিএফও আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত দুই কর্মকর্তা মোহাম্মদ আসাদুর রহমান এবং মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়ার বেতন একবারে ৮০ শতাংশের ওপরে বাড়ানো হয়েছে।

মোহাম্মদ আসাদুর রহমানের মাসিক বেতন চলতি বছরের এপ্রিলে ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার টাকা, যা জুন মাসে বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। এ বেতন বৃদ্ধির হার ৮২ শতাংশ। অপর কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের বেতন এপ্রিলে ছিল ৭১ হাজার টাকা। জুলাইতে এই বেতন ৮৫ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ২৫০ টাকা।

এই দুই কর্মকর্তার এমন অস্বাভাবিক বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি এমডি, সিএফও, সিটিও’র বেতনও বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। এমডি মাজেদুর রহমান নিজের বেতন ৫ লাখ টাকা থেকে ২০ শতাংশ বাড়িয়ে ৬ লাখ করে নিয়েছেন। সিএফও আব্দুল মতিন পাটোয়ারী এবং সিটিও জিয়াউল করিমের বেতন ২১ শতাংশ বেড়ে ৪ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা করা হয়েছে।

এর মধ্যে সিএফও এবং সিটিও পদ দুটি চুক্তিভিত্তিক থকায় এই দুই পদে উচ্চ বেতনে প্রবেশ করেন আব্দুল মতিন পাটোয়ারী এবং জিয়াউল করিম। কিন্তু ডিএসইতে যোগদানের পর তারা নিজেদের পদ দুটি স্থায়ী করে নেন। তবে পদ দুটি স্থায়ী করা হলেও বেতন কাঠানো নতুন করে নির্ধারণ করা হয়নি। বরং নতুন করে তারা গ্রাচ্যুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, আর্ন লিভ, ওয়ার্কার প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড সুবিধা পাচ্ছেন।

এতে এই দুই কর্মকর্তা গড়ে প্রতিমাসে যে বেতন পাচ্ছেন, তা এমডির থেকেও বেশি। সব সুবিধা বিবেচনায় নিলে এই দুই কর্মকর্তা প্রতিমাসে গড়ে বেতন-ভাতা পান ৬ লাখ ১১ হাজার টাকার ওপরে। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে নিচের পদে চাকরি করেও দুই কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তা এমডির থেকে প্রতিমাসে গড়ে ১১ হাজার টাকা করে বেশি পাচ্ছেন।

কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ 

এমন বেতন বৈষম্যের কারণে ডিএসইর কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছেন। ইতোমধ্যে একজন এজিএম পদত্যাগ করেছেন। আর এক কর্মকর্তা সিএফও’র সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। সেই তর্কের ২৬ মিনিট ২৭ সেকেন্ডের একটি অডিও ইউটিউব ছড়িয়ে পড়েছে।

ছড়িয়ে পড়া রেকর্ড থেকে জানা যায়, ফৌজিয়া সিদ্দিক নামের ওই ক্ষুব্ধ কর্মকর্তা সিএফও আব্দুল মতিন পাটুয়ারিকে উদ্দেশ করে বলেন- পৃথিবীর কোথাও নেই সি লেভেলের কর্মকর্তা স্থায়ী চাকরি করেন। কিন্তু আপনি করেন। এটি এক ধরনের অনিয়ম। এর আগেও আপনার কাছে জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি বলতে পারেননি। আপনার কেপিআই (কি পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর) কী। আপনার কেপিআই কর্মচারীদের বেতন কমানো। খরচ কমানোর মানে কর্মচারীদের বেতন কমানো নয়। তাদের সুযোগ কমানো নয়। আপনি আয় বাড়াবেন। সে জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।

ওই নারী কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, এখানে কাজের মূল্যায়ন করা হয় না। এখানে বেতন অর্ধেক করে দেবেন আর আমরা কাজ করব। আপনি একজন স্থায়ী চাকরিজীবী? আপনি সর্বোচ্চ বেতনভোগী। আপনার বেতন কত? আপনার বেতন দেড় থেকে দুই লাখ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। অথচ আপনি অনেক বেশি নিচ্ছেন। আপনিতো অনিয়ম করছেন। এ সময় সিএফও বলেন, এটি আমি নিচ্ছি না। আমাকে দেয়া হয়েছে।

ওই নারী কর্মকর্তা অভিমান করে বলেন, আপনি কন্ট্রিবিউট করা ছাড়াই টাকা পাচ্ছেন। তাহলে আমরা কাজ করব কেন। আপনি আমাদের মতো পিএফ, ইন্স্যুরেন্স সুবিধা নিচ্ছেন। আপনি স্যালারি বেশি নিচ্ছেন। আপনার কন্ট্রিবিউশন কী। কেউ কি বলতে পারবেন সিএফও স্যার আসার পর স্টক এক্সচেঞ্জে এই জিনিসটা চেঞ্জ হয়েছে। স্যালারি কমানো ছাড়া আর কিছুই করেননি। আাপনি কেন বেশি স্যালারি নিচ্ছেন। আপনি জাতে মাতাল তালে ঠিক। আপনার বেলায় আপনি ষোল আনা।

এই অডিও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ার পর ডিএসইর কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। তবে চাকরির ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না। এদিকে সিএফও’র সঙ্গে অধীনস্ত কর্মকর্তার কথাপোকথন রেকর্ড করা এবং তা ইউটিউবে ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়ে মৌখিকভাবে ডিএসইর এমডি তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কে রেকর্ড করেছেন এবং কে ইউটিউবে ছড়িয়ে দিয়েছেন তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওই সদস্যদের। তবে বেতন বৈষম্যের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

এসব অনিয়মের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান বলেন, কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ানো হয়েছে ডিএসইর নিয়ম অনুযায়ী। আর এটি ডিএসইর অভ্যান্তরীণ বিষয়। সুতরাং এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাই না।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সিএফও ও সিটিও’র পদ দুটি স্থায়ী করা এবং তাদের অতিরিক্ত সুবিধা দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি সঠিক না। আর সব কথা ফোনে বলাও সম্ভব না।

সিএফও আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর সঙ্গে নারী কর্মকর্তার তর্কের অডিও নিচে...

এমএএস/জেডএ/আইআই

স্থায়ী কর্মকর্তাদের বেতন বছরে বাড়ার কথা সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ। কিন্তু দুজন কর্মকর্তার বেতন ৮০ শতাংশের ওপর বাড়ানো হয়েছে। আবার সিএফও এবং সিটিও’র চাকরি চুক্তিভিত্তিক হলেও তারা তা স্থায়ী করে নিয়েছেন।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।