বাড়িভাড়ায় নৈরাজ্য, বাস্তবায়ন নেই আইনের

মাসুদ রানা
মাসুদ রানা মাসুদ রানা , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৩:৫৩ এএম, ০২ ডিসেম্বর ২০১৭
ফাইল ছবি

বাড়িভাড়া নিয়ে চলছে নৈরাজ্য। বাড়িওয়ালারা যখন ইচ্ছা তখন বাড়িভাড়া বাড়াচ্ছেন। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়িভাড়ায় নৈরাজ্য ভাড়াটিয়া জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। আসছে নতুন বছর। প্রতি বছর জানুয়ারি এলেই ভাড়া বৃদ্ধির খড়গ নামে ভাড়াটিয়াদের উপর।

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ২৬ বছর আগে আইন করা হয়, কোনদিন তা প্রয়োগ হয়নি। বাড়িভাড়া নিয়ে বাড়িওয়ালাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তারপরও বাড়িভাড়া নৈরাজ্য রোধে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।

বাড়িভাড়া নিয়ে বাড়িওয়ালাদের স্বেচ্ছাচারিতা মূলত ঢাকায় বেশি। ঢাকায় বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ভাড়ার রশিদ না দেয়া, ইচ্ছামত ভাড়া বৃদ্ধি, জোর করে ভাড়াটিয়া উচ্ছেদসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। ভাড়াটিয়ারা জানিয়েছেন, অগ্রিম ভাড়া, বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ কাজের খরচ, ইউটিলিটি বিল নেয়ার ক্ষেত্রেও আইন-কানুনের তোয়াক্কা করছেন না বাড়ির মালিকরা।

অন্য বছরের মতো ঢাকায় প্রায় সব বাড়িওয়ালাই ইতোমধ্যে আগামী জানুয়ারি থেকে ভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ দিয়েছেন ভাড়াটিয়াদের। এ বৃদ্ধির পরিমাণ সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বলে জানিয়েছেন ভাড়াটিয়ারা।

সরকার ১৯৯১ সালে ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন এলাকায় নিয়ন্ত্রক, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক ও উপ-নিয়ন্ত্রক নিয়োগেরও বিধান রাখা হয়েছে আইনে। আইনটি প্রণয়নের পর ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকা ও অবস্থানভেদে ভাড়ার হারও নির্ধারণ করে। কিন্তু পরে এসব কিছুই আর বাস্তবায়ন করা হয়নি।

বাড়িভাড়া নিয়ে বিরোধের কারণ চিহ্নিত করতে ২০১৫ সালের ১ জুলাই উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিশন গঠন করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। ছয়মাসের মধ্যে এই কমিশন গঠন করতে বলে উচ্চ আদালত। কিন্তু এ বিষয়েও সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই।

এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাড়িভাড়া সংক্রান্ত কমিশন গঠনের বিষয়ে আমার এই মুহূর্তে কোনো কিছু মনে পড়ছে না।’

জাতীয় ভাড়াটিয়া পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের পর ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকা ও অবস্থানভেদে ভাড়ার হারও নির্ধারণ করে। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সেই হার পুনর্নির্ধারণ করে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে দিয়েছি। আইনটি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছি। কিন্তু কেউই তা আমলে নিচ্ছে না। এ সুযোগে বাড়িওয়ালারা ইচ্ছা মত ভাড়া আদায় করে নিচ্ছে।’

ঢাকার ৮৩ শতাংশ মানুষ ভাড়া থাকে বাকিরা বাড়িওয়ালা উল্লেখ করে মোস্তাক হোসেন বলেন, ‘বেশির ভাগ বাড়িওয়ালাই ভাড়ার রশিদ দেন না। চুক্তি করেন না। কোন বাড়ির মালিক চুক্তি করলেও সব শর্ত থাকে নিজের পক্ষে। জোর করে ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ, ইচ্ছা মতো ভাড়া বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো সবার চোখের সামনে হচ্ছে। কিন্তু দেখার কেউ নাই। বাড়িভাড়া এখন লাভজনক বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।’

ঢাকায় বাড়ির মালিকরা সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া বৃদ্ধি করছেন জানিয়ে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘এ অবস্থা নিরসনে সরকার পদক্ষেপ না নিলে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়ার বিরোধ বড় ধরনের সংঘাতে রূপ নেবে।’

মিরপুর-১০ এর সেনপাড়া পর্বতা এলাকার বাসিন্দা মো. ইদ্রিস হোসেন বলেন, ‘আমি এখন যে বাসায় আছি সেখানে তিন বছর আগে সাড়ে ১১ হাজার টাকা ভাড়ায় উঠেছি। এখন ভাড়া বেড়ে সাড়ে ১৭ হাজার টাকা হয়েছে।’

ven

তিনি আরও বলেন, ‘জানুয়ারি হচ্ছে ভাড়া বৃদ্ধির মাস। প্রতি বছর বাড়িভাড়ার সঙ্গে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিও নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় ভাড়াটিয়া হিসেবে টিকে থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠেছে। ’

২০১০ সালে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ বাড়িভাড়া নৈরাজ্য নিয়ে একটি রিট আবেদন করে। এরপর ২০১৩ সালে রুলের শুনানি শেষ হয়। ২০১৫ সালের ১ জুলাই রায় দেয় আদালত।

কমিশন গঠনের নির্দেশনা দিয়ে আদালতের আদেশে বলা হয়, কমিশনের প্রধান হবেন একজন আইনজ্ঞ। কমিশনে সদস্য থাকবেন ৭ জন। সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া বিরোধের কারণ নির্ণয় ও প্রতিকারের উপায় সুপারিশ করবে কমিশন। এই কমিশন বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের মতামত নিয়ে, প্রয়োজনে গণশুনানি করে এলাকা ভিত্তিক সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করবে।

যা আছে বাড়িভাড়া আইনে
“বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১” অনুযায়ী প্রতি দুই বছর পর (নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে) ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করা যাবে। কিন্তু ঢাকায় বছরে দুইবার ভাড়া বৃদ্ধির নজিরও আছে।

ভাড়ার রসিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশের কথা বলা হয়েছে আইনে। বাড়িভাড়া আইন অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রকের লিখিত আদেশ ছাড়া কোনো অগ্রিম ভাড়া আদায় করা যাবে না। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ একমাসের অগ্রিম ভাড়া গ্রহণ করা যেতে পারে।

আইনে বলা হয়েছে, ভাড়াটিয়া যদি নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করতে থাকেন এবং বাড়ি ভাড়ার শর্ত মেনে চলেন তাহলে যতদিন ভাড়াটিয়া চাইবেন ততদিন থাকবেন, তাকে উচ্ছেদ করা যাবে না। এমনকি বাড়ির মালিক পরিবর্তিত হলেও ভাড়াটিয়া যদি আইনসম্মত ভাড়া প্রদানে রাজি থাকেন, তবে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না।

আইন অনুযায়ী, ভাড়ার আগে দুই পক্ষের মধ্যে লিখিত চুক্তি থাকতে হবে।

অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ভাড়ার রশিদ দিতে ব্যর্থসহ নানা অপরাধের জন্য জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে।

আরএমএম/জেএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।