রোহিঙ্গারা ভূ-রাজনৈতিক আগ্রাসনের শিকার
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার। কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ নিয়ে গবেষণা করছেন, লিখছেন রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়েও।
রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। ‘রোহিঙ্গা সঙ্কট আন্তর্জাতিক ইস্যু’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধর্মীয় ও জাতিগত দ্বন্দ্ব থাকলেও ভারত, চীন ও রাশিয়ার আগ্রাসী নীতির কারণে এ সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে চলমান সঙ্কট আশু সমাধানও দেখছেন না এই বিশ্লেষক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। তিন পর্বের প্রথম পর্ব আজ প্রকাশিত হলো।
জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা সঙ্কট কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
সাখাওয়াত হোসেন : রোহিঙ্গা সঙ্কট এখন রীতিমতো আন্তর্জাতিক ইস্যু। মিয়ানমার দীর্ঘদিন থেকে পরিকল্পনা করেছে রাখাইন অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেয়ার। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে কথা বলতে হলে আগে আরাকানের ইতিহাস নিয়ে আলোকপাত করা দরকার।
জাগো নিউজ : একটি সম্প্রদায়কে নিজ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার পেছনের কারণ কী থাকতে পারে?
সাখাওয়াত হোসেন : আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিসংখ্যান নিয়ে যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিশ্বশক্তির কাছে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোহিঙ্গারা ভূ-রাজনৈতিক আগ্রাসনের শিকার।
ত্রিমুখী প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের গুরুত্ব প্রকাশ পাচ্ছে বলে আমি মনে করি। ভারত-চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর, চীন সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে এ তিন দেশের ভূ-রাজনৈতিক বিশেষ অবস্থান রয়েছে।
ভারতের সঙ্গে চীনের প্রতিযোগিতা হচ্ছে আঞ্চলিক ইস্যু। আর চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা হচ্ছে আন্তর্জাতিক।
রোহিঙ্গা ইস্যু বিশ্লেষণ করতে হলে রাষ্ট্রগুলোর এ প্রতিযোগিতা আমলে নিতে হবে। ভারত ও চীন হচ্ছে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দুটি বড় রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্র দুটির সঙ্গে মিয়ানমারের ঐতিহাসিক যোগাযোগ আছে।
জাগো নিউজ : যোগাযোগ প্রসঙ্গে যদি ব্যাখ্যা করতেন?
সাখাওয়াত হোসেন : বৌদ্ধ ধর্ম ক্রমশই পূর্ব দিকে প্রচার হয়েছে। বাংলায় হর্ষবর্ধন ও শশাঙ্কের পর বৌদ্ধদের রাজত্ব ক্রমেই বিলুপ্ত হয়েছে। হিন্দু ও মুসলমানদের রাজত্ব বাংলায় গুরুত্ব পাওয়ার পরই বৌদ্ধদের প্রচার পূর্ব দিকে যেতে থাকে। অশোকও বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করেছিলেন পূর্ব দিকে গিয়ে।
এ কারণেই আপনি দেখবেন ভারতে বৌদ্ধ সম্প্রদায় হচ্ছে পূর্ব দিকে। আর পূর্বের যে রাষ্ট্রগুলোয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা রয়েছে, এর মধ্যে মিয়ানমারের বৌদ্ধরা হচ্ছে পুরাতন। ভারতের পরই মিয়ানমারে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার।
আরবদের বাণিজ্যের মাধ্যমে নবম শতাব্দীতে এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রসার হতে থাকে। অর্থাৎ দুটি বড় ধর্ম যার একটি ভারতে উত্থান অপরটি মধ্যপ্রাচ্যে।
মিয়ানমারের আরাকানে রোহিঙ্গারা নবম-দশম শতাব্দীতে বসবাস শুরু করতে থাকে। তাদের ভাষাও আরাকানের (রোহিঙ্গা)।
জাগো নিউজ : আরাকানে বৌদ্ধদের প্রভাব বাড়তে থাকল কখন?
সাখাওয়াত হোসেন : বিংশ শতাব্দীর পর আরাকানে বৌদ্ধদের প্রভাব বাড়তে থাকে।
বার্মিজ-অ্যাংলো যুদ্ধের পর আরাকান অঞ্চল ব্রিটিশ ভারতের সঙ্গে চলে আসে। ১৮৩৪ ও ১৮৩৫ সালের দিকে সেখানে আরও রোহিঙ্গা বসতি গড়ে ওঠে। মুঘল আমলে আরাকান আলাদা রাজ্য ছিল। পরে বার্মিজরা দখল করে। এরপর ব্রিটিশরা দখলে নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যখন গোটা বার্মা দখল করল, এর আগে থেকেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করতে থাকে বার্মিজরা। মূলত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকেই অং সানের (অং সান সু চি’র বাবা) উঠে আসা। বর্তমান স্টেট কাউন্সিলর ও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চি’র বাবা অং সানের অত্যন্ত কাছের দুজন বাঙালি ছিলেন ঘোষাল ও ড. নাগ। পূর্ববাংলার আরও অনেকেই ছিলেন।
রেঙ্গুনে রাজধানী যাওয়ার পর রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালি ভারতীয়দের অনেকেই পড়তে যান এবং সেখানে সেটেল (স্থায়ী বসবাস) হতে থাকেন। রেঙ্গুন শহরটিও গড়ে ওঠে ভারতীয়দের প্রভাবে। রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।
বার্মার স্বাধীনতা আন্দোলনে কাচিন, চিন, কারেনের মতো বড় বড় রাজ্যগুলোও সম্পৃক্ত হয়। এ আন্দোলনে রোহিঙ্গারাও যুক্ত হয়। রাজ্যগুলোর স্বায়ত্তশাসনের জন্য গঠিত হয় ‘ইউনিয়ন অব বার্মা’।
জাপানিরা দখল করার পর ১৯৪২ সালে বার্মার আরাকানে বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যে একটি দাঙ্গা সংঘটিত হয়।
জাগো নিউজ : দাঙ্গার কারণ কী?
সাখাওয়াত হোসেন : রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিল। জাপানিদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর ব্রিটিশরা সেখান থেকে চলে যায়। পরে আবার যখন ফিরে আসে ব্রিটিশরা, তখন আবারও মিলে যায় রোহিঙ্গারা।
এ সময় অং সান জাপানিদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি জাপানে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে ব্রিগেড বানান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাপানও কথা রাখেনি বলে অং সান একই সঙ্গে ব্রিটিশ ও জাপানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন।
সে সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও অং সানের মধ্যে স্বাধীনতার প্রশ্নে একটি চুক্তি হয়। অং সানকে প্রধানমন্ত্রী করে একটি সরকার ও মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। সেই মন্ত্রিসভায় মিস্টার আজিজ নামে একজন মুসলমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত। সে সময় অং সান রোহিঙ্গাদের সমর্থন পান।
১৯৪৭ সালে অং সান সু চির বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। এর কিছুদিন পরই তার বাবা অং সান কমিউনিস্ট বিদ্রোহীদের হামলায় নিহত হন। সু চির চাচাকেও মেরে ফেলা হয়। ওই সময় শীর্ষ আট নেতাকে হত্যা করা হয়, যার মধ্যে রোহিঙ্গা নেতা আব্দুর রাজ্জাকও ছিলেন। এরপর ঘোষাল ও ড. নাগ আন্ডার গ্রাউন্ডে যাওয়া কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। পরে ওই দুজনকেই অ্যামবুশ করে মারা হয়।
এ ইতিহাস হচ্ছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির।
জাগো নিউজ : ভারত ভাগের সময় রোহিঙ্গাদের অবস্থান কী ছিল?
সাখাওয়াত হোসেন : ভারত ভাগের সময় রোহিঙ্গারা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিল। ওই সময় মুসলিম লীগের নেতারা আরাকানকে পাকিস্তানের সঙ্গে নিলেন না। তারা বললেন, তোমরা বার্মার সঙ্গে থাক।
রোহিঙ্গারা বুঝতে পারছিল যে, তারা এক সময় বার্মার সঙ্গে থাকতে পারবে না। পাকিস্তানে যুক্ত হতে না পারায় তখন রোহিঙ্গারা আরাকান মুজাহিদীন নামের একটি সংগঠন করল। তাদের লক্ষ্য হলো আরাকানকে স্বাধীন করা।
জাগো নিউজ : আরাকান মুজাহিদীন তো ব্যর্থ হলো?
সাখাওয়াত হোসেন : অনেক দিন যুদ্ধ পরিচালনার পর তারা আন্দোলন থেকে সরে আসে। বার্মা সরকারের কাছে ১৯৬১ সালে তারা আত্মসমর্পণ করে। শর্ত ছিল রোহিঙ্গাদের স্বায়ত্তশাসন দেয়ার। তবে মুজাহিদীনের একটি অংশ নতি স্বীকার করল না।
১৯৬২ সালে বার্মায় যখন মার্শাল ল’ জারি হয় তখন আরাকানের রোহিঙ্গাদের বহিরাগত বলে আখ্যা দেয়া শুরু হয়। সে সময় আত্মসমর্পণ না করা অংশটি ছোট ছোট গ্রুপে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে।
এএসএস/এমএআর/আইআই