সবার মত ধারণ করেই কাজ করতে চাই
অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮তম উপাচার্য হিসেবে সম্প্রতি নিয়োগ পেয়েছেন। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে প্রথম উপাচার্যও তিনি। ১৯৯০ সালে এই বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ পাওয়ার পর দায়িত্ব পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষক সমিতির টানা তিনবারের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০০৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন কবি জসীম উদদীন হলের প্রাধ্যক্ষ। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য, ২০১৬ সালের ২২ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) পদে নিয়োগ পান। এর আগে ছিলেন কলা অনুষদের ডিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আখতারুজ্জামান। ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন কলেজের ফুলব্রাইট স্কলার এবং যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো ছিলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন দায়িত্ব গ্রহণের পর সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক মুনির হোসাইন। দুই পর্বের শেষটি আজ প্রকাশিত হলো।
জাগো নিউজ : প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। এরপরও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, র্যাং কিংয়েও গত কয়েক বছরে পিছিয়ে পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেবেন কি না?
অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান : এখানে বলা দরকার, আমরা অপরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলেছি। ফলে শিক্ষার্থীদের জীবনমান, গুণগত মান, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির যে অনুপাত সেগুলোতে বড় আকারে ফারাক হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীর তুলনায় অবকাঠামো না বাড়িয়ে আমরা শিক্ষার্থীর সংখ্যাই শুধু বাড়িয়ে নিয়েছি। যে অপরিকল্পিত বিকাশহীন সম্প্রসারণ হয়েছে সেটি আজ একটি বড় ফ্যাক্টর (কারণ) হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা চাই আমাদের এখন যে শিক্ষার্থী আছে, তাদের তো কমাতে পারব না; তাদের রেখেই ভাবতে হবে কী কী সহায়ক উপাদান দরকার। সে সহায়ক উপাদানগুলোর সংযোজন ঘটানোই হবে আমাদের কাজ। সেটিও রাতারাতি সম্ভব নয়।
লাইব্রেরিতে আমাদের শিক্ষার্থীরা বসতে পারছে না, হলে থাকতে পারছে না, ক্লাসরুমে ধারণক্ষমতা কম, শিক্ষকের আই কন্টাক্টে আসছে না শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীকে না চেনে তাহলে তার মধ্যে শিক্ষকের দর্শন প্রবেশ করে না।
শিক্ষার্থীদের সংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্লাসরুমের সাইজ, অন্যান্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হবে।
জাগো নিউজ : বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্সের সম্প্রসারণ বেশি হয়েছে, তৈরি হচ্ছে নিম্নমানের গ্রাজুয়েট। কোনো কোনো বিভাগ কিংবা ইনস্টিটিউটে নিয়মিত শিক্ষার্থীর কয়েকগুণ বেশি ভর্তি করা হচ্ছে সান্ধ্য কোর্সে…
অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান : একটি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সান্ধ্য কোর্স করা হয়েছিল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্পেশালাইজড তৈরির জন্য। তখন আমরা চেয়েছিলাম অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীকে এর আওতায় আনতে যাতে জাতীয় উন্নয়নে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে এর সম্প্রসারণ একটু বেশি ঘটে গেছে। এখন আমাদের কিছু সমন্বিত নীতিমালা প্রয়োজন হবে।
দেখতে হবে কোনোক্রমেই যেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমাদের লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদের মূল কার্যক্রম নিয়মিত রাখা, তাদের গুণগত শিক্ষা দিতে পারা। তাদের সঙ্গে শিক্ষকদের যে বন্ধন সে বন্ধন সুদৃঢ় করা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমরা এমন কোনো প্রোগ্রাম চালাব না, সেটি একেবারেই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে থাকবে না, প্রত্যাশিতও হবে না।
জাগো নিউজ : পত্র-পত্রিকায় এসেছে, গত কয়েক বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে পক্ষপাতিত্ব হয়েছে, অনিয়মও হয়েছে ব্যাপক। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আপনার পরিকল্পনা কী হবে?
অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ যেকোনো নিয়োগ আমাদের কতিপয় সংবিধিবদ্ধ কাঠামো ও বডির মাধ্যমে হয়। কিছু আইন দ্বারা সেটি নিয়ন্ত্রিত হয়। সিলেকশন প্রক্রিয়াটিও বিভিন্নভাবে সম্পাদিত হয়। যার সঙ্গে অনেকগুলো কম্পোনেন্ট (উপাদান) জড়িত।
নিয়োগের ক্ষেত্রে কখনও কখনও আইনি ব্যত্যয়, কখনও যেটি কাম্য ছিল না সেটি হয়েছে। মহামান্য আদালতেও এ রকম দু-একটি ঘটনা চিহ্নিত হয়েছে। এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। অতীতের ভুল কিংবা ব্যত্যয় থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, যেন এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। যদি একটি গুণগত ও মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যদি উপরের দিকে নিতে চাই তাহলে আইন, নিয়ম-কানুন, বিধিবিধানগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করাও একটি বড় ইন্ডিকেটর (সূচক)। বিষয়গুলো আমরা যথাযথভাবে অনুসরণে উদ্যোগী হব। অতীত ভুলের যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেদিকে আমরা সচেষ্ট থাকব।
জাগো নিউজ : শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের প্রমাণ পেলে আপনাদের কোনো পদক্ষেপ থাকবে কি না?
অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান : এটা একটু জটিল। কারণ নিয়োগের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা কেউ না কেউ জড়িত ছিলাম। ভুল-ভ্রান্তি, ত্রুটি, আইনের পরিপন্থী যদি কিছু হয় সেগুলো আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসবে। ফলে উত্তম কাজ, নৈতিক ও বড় দায়িত্ব হবে এসব ভুল-ভ্রান্তির যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে; তা অনুসরণ করা। তাহলে সভ্যতার মানদণ্ডে আমরা সামনের দিকে এগোতে পারব। পেছন কিংবা অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে, সেটি ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই হবে আমাদের মূল লক্ষ্য।
জাগো নিউজ : ক্যাম্পাসের বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা সন্তোষজনক নয়। বহিরাগতদের বাহন চলছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। নিরাপত্তার ব্যাপারে আপনার উদ্যোগ কী হবে?
অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান : আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি ঢাকা শহরের এমন এক জায়গায় অবস্থান করছে, যেটি একেবারেই সিলবদ্ধ করে রাখা যাবে না। করলে ঢাকা শহর অচল হয়ে যাবে। এর মধ্য দিয়েই একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা রাখতে হবে। নিরাপত্তা হুমকির জন্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধিও একটি কারণ। সব রোগের যে কারণ সেটি হচ্ছে আমাদের এখানে অধিক জনসংখ্যা। আমরা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি। সম্প্রতি পুলিশের ঊর্ধ্বতন একটি টিম আমার সঙ্গে দেখা করেছে। তারা বলেছেন, নিরাপত্তার বিষয়ে তারা সজাগ। আমরা যদি তাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে সমন্বয় করে কাজ করি তাহলে অনেকগুলো দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদেরও সচেতন করে তুলব। সেটি হোক ক্লাসরুম বা অন্য মাধ্যম কিংবা কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম, সেগুলো কার্যকর করা। ছেলে-মেয়েরা যেন বোঝে তারা কীভাবে এ ক্যাম্পাসে চলাফেরা করবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে তাদের দায়িত্ব কতটুকু; এসব বিষয় সম্পর্কে আমরা তাদের আগ্রহী করে তুলব।
তাদের (শিক্ষার্থীদের) মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজেদেরই উদ্যোগী করে তোলা, যেন মানবিক অনেক গুণাবলি তাদের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। এটিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শিক্ষা। ফলে এ শিখন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা একধাপ এগিয়ে নিতে পারি। আমরা নিজেরাই সচেতন হলে অনেক বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে পারি।
জাগো নিউজ : অধিভুক্ত কলেজগুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং অধিভুক্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। এখানকার শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সময়মতো ক্লাস, পরীক্ষা ও ফলাফল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে অধিভুক্তরা বলছেন, তারাও সেশনজটে পড়ছেন। শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, সদ্য বিদায়ী উপাচার্য জোর করে এগুলো নিয়েছেন…
অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান : আসলে এটি খুব সুপরিকল্পিতভাবে হয়নি, সমন্বিতভাবে প্রয়াস নেয়া হয়নি। এর ঘাটতিগুলো আমি এখন লক্ষ্য করছি। এখন দোষারোপের অবস্থা থেকে বললে প্রক্রিয়াটি ভালো ছিল না।
দোষারোপ করে সমস্যার সুরাহা কিংবা সমাধান হয় না। এখন যেহেতু এগুলো অধিভুক্ত হয়ে গেছে সেহেতু এর থেকে উত্তরণের উপায় কী হবে- সেটি আমাদের বের করতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কিন্তু কর্মপদ্ধতি তো আমাদেরই করতে হবে, সেটি প্রধানমন্ত্রী করবেন না। তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন মাত্র। আমরা সেগুলোর বাস্তবায়ন করব। নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোন ধরনের কর্মপন্থা দরকার সেটি আমাদের বের করতে হবে। আমি লক্ষ্য করছি, কিছু পরিকল্পনা ও কাজের সমন্বয়ের ঘাটতি আছে। সেটি এখন আমাদের দেখতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা এসেছেন তারাও একটু পিছিয়ে পড়ছে, এটি সত্য।
জাগো নিউজ : উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে একটু মান-অভিমান আছে। পত্র-পত্রিকায় এসেছে আপনি দায়িত্ব নিয়ে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন…
অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান : শুরুর দিন থেকে এখন আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত একটু একটু করে ভালো হচ্ছে। আগামীতে আরও ভালো হবে। সব মানুষের মধ্যে সংহতি আনায়ন এবং তাদের সব মত ধারণ করে কাজ করাই হচ্ছে আমার কাজ। আমি বলতে পারি, আমরা ক্রমান্বয়ে ভালোর দিকে যাচ্ছি। এটিই হলো আশার কথা।
এমএইচ/এমএআর/আরআইপি