এক ফাতেমার জন্য ৯ দম্পতির যুদ্ধ
রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফেলে যাওয়া অবুঝ শিশু ফাতেমা। এই ফাতেমার বৈধ অভিভাবকত্বের জন্য শেষ পর্যন্ত আদালতে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন আবেদনকারী ৯ দম্পতি। যেকোনো কিছুর বিনিময় তারা চেয়েছিলেন ফাতেমার অভিভাবকত্ব। তার অভিভাবকত্ব পাওয়ার জন্য ছিলেন সবাই যোগ্য। কিন্তু সবকিছু বিবেচনা করে ফাতেমাকে পাবেন এক দম্পতি। এটা কিছুতেই মানতে রাজি ছিলেন না কোনো দম্পতি।
বুধবার ঢাকার শিশু আদালতের বিচারক মো. হাফিজুর রহমান সবকিছু বিবেচনা করে শিশুটির বৈধ অভিভাবক হিসেবে আইনজীবী সেলিনা আক্তারকে মনোনীত করেন। এ সময় তার আদেশ মানতে রাজি হননি অনেক দম্পতি। তারা অনেকেই এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা বলেন। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। আবার অনেকেই বলতে থাকেন এটা ন্যায়বিচার হয়নি।
এদিন দুই দফায় শিশু ফাতিমার বৈধ অভিভাবকত্বের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। বেলা আড়াইটায় বিচারক এজলাসে ওঠেন। বিচারক বলেন, ৯ দম্পত্তিই শিশু ফাতিমাকে পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, একজনকে শিশুটির অভিভাবক হিসেবে আমাকে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। এখানে অন্যদের মন খারাপ করার কিছুই নেই। শিশু ফাতিমা ভালো থাক তা আমরা সবাই চাই।
বিচারক ফাতেমার অভিভাবকত্ব দেয়ার জন্য আইনজীবী সেলিনা আক্তারকে মনোনীত করেন। তিনি ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় আশিক ওয়াহিদ ও তৃতীয় গোলাম সারোয়ার ফাতিমাকে পাবেন।
বিচারক সেলিনাকে জিজ্ঞাসা করেন, ফাতেমার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য কিছু টাকার এফডিআর (স্থায়ী আমানত) করতে হবে। এ সময় তিনি বলেন, আপনি যা চাইবেন আমি তাই করব। তখন অন্য দম্পতিরা বলেন, উনি কত করতে পারবেন। আমরা তার চেয়ে বেশি এফডিআর করব। আদালতে উনি খোলাখোলি বলুক।
এ সময় অনেকে ফাতেমার নামে ফ্ল্যাট লিখে দিতে চাইলেন। অনেকেই বলেন, আমরা আমাদের সারা জীবনের সঞ্চয় তার নামে লিখে দেব। তাকে সন্তানের মতো মানুষ করব। এ সময় আদালতের পরিবেশ ছিল অনেকটাই উত্তপ্ত। সবাই ফাতেমাকে নিতে চালাচ্ছিলেন বাকযুদ্ধ। কেউ কাউকে ছাড় দিতে একবিন্দুও রাজি ছিলেন না।
তখন বিচারক বলেন, ঠিক আছে তাহলে সবার কাছে আমি আবার আলাদা আলাদা শুনব, যাকে উপযুক্ত মনে হবে তাকেই ফাতেমার দায়িত্ব দেব। এরপর বিচারক নিয়মিত কিছু মামলা কার্যক্রম শেষ করে বেলা সোয়া ৩টার দিকে খাসকামরায় যান। এরপর একে একে সব দম্পতিকে তার খাসকামরায় ডেকে তাদের বক্তব্য শোনেন। এ সময় কে পাবেন ফাতেমাকে এ নিয়ে আদালতে চলে জল্পনা-কল্পনা। একটু পরপর ফাতেমাকে দেখে আসছেন অনেকেই।
দ্বিতীয় দফায় তিনি পৌনে ৫টার দিকে এজলাসে ওঠেন। তিনি এজলাসে বলেন, এটা এমন একটি বিষয় যার সিদ্ধান্ত নেয়া অনেক কঠিন। অপ্রিয় হলেও এর সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হবে। আবার সবার উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা ৯ দম্পতিই ফাতেমাকে পাওয়ার যোগ্য। সবদিক বিবেচনা করে আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, আইনজীবী সেলিনা আক্তারকে শিশু ফাতিমার ‘বৈধ অভিভাবকত্বের’ জন্য নির্ধারণ করলাম।
একই সঙ্গে আদালত ২২ আগস্ট তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে সেলিনা-আলমগীর দম্পতির কাছে শিশুটিকে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। এছাড়া শিশুটির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য ওই দম্পতিকে পাঁচ লাখ টাকার এফডিআর (ফিক্সড ডিপোজিট রেট) করারও নির্দেশ দেন আদালত।
এ সময় আবেদনকারী ব্যবসায়ী শামসুল আলম চৌধুরী আদালতকে বলেন, স্যার এটার জন্য কি আপিল করতে পারব। আমি ফাতিমাকে পাওয়ার জন্য উচ্চ আদালতে যাব। বিচারক তখন বলেন, মনে হয় এজন্য আপিল করা যায় না। এরপর বিচারক এজলাস ত্যাগ করে খাসকামরায় চলে যান।
তখন শামসুল আলম চৌধুরীর স্ত্রী শামিমা আক্তার চৌধুরী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি আদালতের বাইরে এসে বলতে থাকেন, অনেক আশা করছিলাম ফাতেমার দায়িত্ব পাব। আমার ২০ বছর ধরে সন্তান হয় না। আদালত এটা কী বিচার করল। এই বিচার সঠিক হয়নি।
এ সময় অপর দম্পতির চোখে দেখা যায় পানি। অনেকেই বলতে থাকেন, ন্যায়বিচার হয়নি। তিনি আইনজীবী (সেলিনা আক্তার) দেখে তাকে বিচারক গুরুত্ব দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ৯ আগস্ট ছোট্ট শিশু ফাতেমার ‘বৈধ অভিভাবকত্ব’ নির্ধারিত হওয়ার কথা থাকলেও বিচারক অসুস্থ থাকায় তা পিছিয়ে বুধবার দিন ধার্য করা হয়েছিল। আজ আবেদনকারী নয় দম্পতি থেকে শিশুটির বাবা-মা বাছাই করা হলো। এর আগে শিশু ফাতেমার প্রকৃত বাবা-মাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার উপ-পরিদর্শক আবু সাঈদ।
প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, আদালতের নির্দেশে বিমানবন্দরের ওইদিনের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। এতে শিশুটির প্রকৃত বাবা-মাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। শিশুটির বাবা-মা দাবি করে কেউ লিগ্যাল নোটিশও দেয়নি। এছাড়া শিশুটি হারিয়ে গেছে মর্মে বিমানবন্দর থানায় কেউ জিডিও করেনি।
জেএ/ওআর/আরআইপি