৫৭ ধারার মামলায় সঠিক তদন্ত হয় না
‘কাগতিয়া হুজুর আট মাস আগে মারা গেছে, তোমরা সবাই মিথ্যা বলতেছ? আর আজকে সবাই বলতেছে কাগতিয়া হুজুর মারা গেছে’- এ শিরোনামে একটি স্ট্যাটাস দেয়ায় চট্টগ্রামের রাউজান দারুল ইসলাম ফাযিল মাদরাসার ছাত্র মোহাম্মদ ইরফানের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়।
২০১৬ সালের ১৬ মে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানায় মামলাটি করেন হুজুরের ভক্ত মোজাম্মেল হোসেন। মামলায় ইরফান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
২০১৭ সালের ২৫ জুলাই সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাইফুল ইসলাম আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের কোনো উপাদান না থাকায় মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন।
বিচারক আদেশে বলেন, ‘মামলার একমাত্র আসামি আদালতে উপস্থিত রয়েছেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী ফৌজদারি কার্যবিধি ২৬৫ ধারা অনুযায়ী অব্যাহতির আবেদন করেছেন। আবেদনে তিনি বলেন, মামলার একমাত্র আসামি ইরফান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় কোনো অপরাধ করেননি। তিনি নির্দোষ, নিরপরাধ। আইটি রিপোর্টে এ ধরনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।’
‘অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ গঠনের আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে অব্যাহতির আবেদন মঞ্জুর করে তাকে (মোহাম্মদ ইরফান) মামলার দায় থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হলো।’
২০১৬ সালের ৪ মে সংঘটিত ওই ঘটনায় ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রাউজান থানার উপ-পরিদর্শক সাইমুল ইসলাম আসামির বিরুদ্ধে ‘ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে’ বলে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
সাইবার ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারাসহ অন্যান্য ধারায় দায়ের করা মামলাগুলো সঠিকভাবে তদন্ত হয় না। সঠিক তদন্তের অভাবে বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়ে যান অনেক আসামি।
তারা জানান, তদন্ত কর্মকর্তারা নামমাত্র তদন্ত করে আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। তদন্তে যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত, তারা তা করেন না। বিশেষ করে আইটি (তথ্যপ্রযুক্তি) রিপোর্ট ও ফরেনসিক রিপোর্ট ছাড়াই তারা চার্জশিট দাখিল করেন।
যথাযথ তথ্য-উপাত্ত সংযোজিত না থাকায় চার্জগঠনের শুনানির দিনই আসামিদের অব্যাহতি প্রদান করেন ট্রাইব্যুনাল। জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত ৫৭টি মামলায় আসামিদের অব্যাহতি প্রদান করেন সাইবার ট্রাইব্যুনাল। আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠনের কোনো উপাদান না থাকায় মূলত তাদের অব্যাহতি প্রদান করা হয়।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেলী ফেরদৌস জাগো নিউজকে বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনটি মূলত নতুন। এ আইনের মামলাগুলো তদন্ত করা অন্যান্য মামলার চেয়ে জটিল। মামলাগুলোর সুষ্ঠু তদন্তের জন্য পর্যাপ্ত উপকরণেরও অভাব আছে আমাদের।
তিনি বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলাগুলো প্রমাণের জন্য আইটি ও ফরেনসিক রিপোর্ট আবশ্যক। যা আমাদের দেশে অপর্যাপ্ত।
তিনি আরও বলেন, অনেক তদন্ত কর্মকর্তা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিষয়ে বোঝেন না। তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ পেলে মামলাগুলোর তদন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যাবে।
সুষ্ঠু তদন্তের অভাবে অব্যাহতি
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর থানার চিনাকান্দির বাসিন্দা মফিজ উদ্দিন তার মেয়ের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ায় ওই এলাকার বাসিন্দা জুনাইদ ও কামাল হোসেনের নামে ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট ৫৭ ধারায় একটি মামলা করেন।
২০১৬ সালের ২৪ জানুয়ারি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মিহির রমুনদেব আসামি জুনাইদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চার্জশিট দাখিল করেন। মামলার অপর আসামি কামরুল হোসেনকে অব্যাহতি দেন।
২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামলার একমাত্র আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের কোনো উপাদান না থাকায় তাকে অব্যাহতি দেন।
বিচারকের আদেশে উল্লেখ করা হয়, ‘যে ছবি প্রচারের জন্য আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে তা অনৈতিক ও অশ্লীল নয়। অভিযুক্ত কোনো ফেসবুক আইডি পরিচালনা করেন না। মামলার কোনো আইটি রিপোর্ট নেই, তার মোবাইলও জব্দ করা হয়নি, পরীক্ষাও করা হয়নি। আসামির বিরুদ্ধে যে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে তা হয়রানিমূলক। তাই মামলার দায় থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হলো।’
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলাগুলো সুষ্ঠুভাবে তদন্ত হয় না। তদন্ত সংস্থাগুলো যদি সুষ্ঠু, আইনানুগ ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে তদন্ত করত তাহলে মানুষ এত হয়রানির শিকার হতো না।
৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ সম্পর্কে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আইনটি তো সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এটি এমন জগাখিচুড়ি পাকিয়ে সামনে আনা হয়েছে, যার কোনোটিই ডিফাইন (অর্থ নির্ধারণ করা) না।
তিনি বলেন, ফৌজদারি অপরাধগুলো হতে হয় খুবই সুনির্দিষ্ট। সময়, স্থান, অপরাধের ধরন নির্দিষ্ট না হলে মামলায় লড়া যায় না। মামলার মেরিট রাখার জন্য অপরাধের নানা বিষয় সুনির্দিষ্ট করতে হয় আইন দ্বারা। সবকিছু অন্ধকারে রেখে তো আপনি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবেন না।
জেএ/এমএআর/পিআর