পুনর্গঠনের আগে শুনানি হচ্ছে না ট্রাইব্যুনালে

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:০৫ এএম, ২৯ জুলাই ২০১৭

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক মারা যাওয়ায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তাতে জরুরি ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন প্রয়োজন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সদস্যরা এমন দাবি করেন।

বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে একটি মামলায় রায় ঘোষণার জন্য এবং পাঁচটি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। পাশাপাশি কয়েকটি মামলার অভিযোগ আমলে নেয়ার জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন হলে ‘সিএভি’ (রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ) মামলার পুনরায় যুক্তিতর্ক শুনতে হবে। এছাড়া নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ না দেয়া পর্যন্ত যেসব মামলার অভিযোগ আমলে নেয়ার জন্য রয়েছে তার আদেশ দেয়া যাবে না। সবকিছু বিবেচনা করে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন জরুরি ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছেন।

আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী দ্রুত সময়ের মধ্যেই ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার পর তা পুনর্গঠন করা হবে।

১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধানে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল গঠন হবে তিন সদস্য নিয়ে। এর মধ্যে একজন চেয়ারম্যান থাকবেন। আর দুজন সদস্য থাকবেন। চেয়ারম্যান যদি সাময়িক অনুপস্থিত থাকেন তা হলে দুজন সদস্য ট্রাইব্যুনালের কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন। তবে তিনি কোনো মামলার রায় বা কোনো মামলার অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন না।

বতর্মান ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মারা যাওয়ার কারণে শূন্যতা দেখা দিয়েছে- বিচারপ্রার্থীরাও এ দাবি করে দ্রুত এ শূন্যতা দূর করে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (অ্যাক্ট) আইন অনুযায়ী, তিনজন বিচারপতির মধ্যে একজন বিচারপতির অনুপস্থিতিতে বিচারিক কার্যক্রম চলবে না। সে হিসেবে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিয়োগ না দেয়া পর্যন্ত মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, যেসব আসামির মামলা শুনানির জন্য দিন-তারিখ ধার্য ছিল সেসব মামলায় আসামিদের হাজির করার পর তাদের ফেরত পঠিয়ে শুনানির জন্য নতুন করে তারিখ ঠিক করে দিচ্ছেন আদালত।

‘চেম্বারে বসে এসব মামলার শুনানির জন্য পরবর্তী তারিখ ঠিক করা হচ্ছে’- জানিয়ে জাগো নিউজকে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. শহীদুল ইসলাম ঝিনুক। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক মারা যাওয়ার কারণে আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল নতুন করে গঠনের প্রয়োজনীতা দেখা দিয়েছে। কারণ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট অনুযায়ী একজন চেয়ারম্যান ও দু’জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে অন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাই ট্রাইব্যুনাল গঠন না করা পর্যন্ত আদালত বসছে না।

ট্রাইব্যুনালের ডেপুটি রেজিস্ট্রার কেশব রায় চৌধুরী জাগো নিউজকে জানান, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক মারা যাওয়ার পর কোনো মামলার শুনানি হয়নি। তবে, যেসব মামলার শুনানির দিন ধার্য ছিল তা আবার শুনানির জন্য বিচারকরা চেম্বারে বসেই নতুন করে তারিখ ঠিক করে দিচ্ছেন। এখন নতুন করে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে তা পুনর্গঠন করা হলে আবারও মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

তিনি আরও জানান, বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে ৩৩টি মামলায় ১৪১ আসামির বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন। ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত ২৯টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে।

এছাড়া রায় ঘোষণার জন্য গাইবান্ধার সাবেক সংসদ সদস্য ও জামায়াতনেতা আবু সালেহ মুহাম্মদ আব্দুল আজিজ মিয়া (৬৫) ওরফে ঘোড়ামারা আজিজসহ ছয় আসামির বিরুদ্ধে করা এক মামলায় শুনানি ও যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) হয়েছে।

অপেক্ষমাণ মামলার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও অন্যতম প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী জাগো নিউজকে জানান, আব্দুল আজিজ মিয়া ওরফে ঘোড়ামারা আজিজসহ ছয় আসামির মামলা, যেটি রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ ছিল তা নতুন করে শুনানি না করলেও ওই মামলায় আবার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে হবে।

তিনি জানান, ওই মামলায় যুক্তিতর্ক শেষ করার পর রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছিলেন আদালত। মামলাটি সিএভি রেখে যেহেতু চেয়ারম্যান মারা গেছেন, সেহেতু নিয়ম অনুযায়ী আবার নতুন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে হবে।

প্রসিকিউটর হৃষিকেশ সাহা বলেন, চেয়ারম্যান মারা যাবার কারণে ট্রাইব্যুনালের কাঠামোতে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন জরুরি।

তিনি আরও বলেন, যে মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য সিএভি রাখা হয়েছে, নতুন চেয়ারম্যান সেই মামলার পুনরায় যুক্তিতর্ক শুনবেন। ফলে মামলাটির রায় ঘোষণা পিছিয়ে গেল।

প্রসিকিউটর সায়েদুল হক সুমন বলেন, যেহেত চেয়ারম্যান মারা গেছেন, তাই বর্তমানে ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এ স্থবিরতা কাটাতে দ্রুত ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে তা পুনর্গঠন করতে হবে। ৪/৫টি মামলার প্রায় ২৫ জন সাক্ষী এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। তাদের বেশিদিন ঢাকায় রাখা যাবে না। সে বিষয়টিও মাথায় রাখেতে হবে।

তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক বলেন, যেহেতু ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মারা গেছেন, সে কারণেই নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ করবেন সরকার। নিয়োগ যত দ্রুত হবে মামলাগুলো তত দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। ট্রাইব্যুনাল থেকেও চেয়ারম্যান করা যেতে পারে আবার হাইকোর্ট থেকেও নেয়া যেতে পারে।

প্রসঙ্গত, ১৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) মারা যান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন

২০১০ সালের ২৫ মার্চ পুরাতন হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। যার চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিমকে। সদস্য পদে নিয়োগ পান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ জহির আহমেদ।

মামলার গুরুত্ব অনুধাবণ করে ২০১২ সালের ২২ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল- ২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। সেখানে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরকে। সদস্য করা হয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন ও জজ মো. শাহিনুর ইসলামকে।

২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর দুটি ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল- ১ এর চেয়ারম্যান হন বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর এবং দুই সদস্য হন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।

ট্রাইব্যুনাল- ২ এর চেয়ারম্যান হন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন। দুই সদস্য হন বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও জেলা জজ মো. শাহীনুর ইসলাম।

২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল- ১ এর সাবকে চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের চাকরির মেয়াদ শষে হয়ে যাওয়ায় অবসরে যান। ২০১৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল- ১ এর চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। আর সদস্য করা হয় বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হককে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল- ২ এর চেয়ারম্যান করা হয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনকে। দুই সদস্য হন বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম।

সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল- ১ নামে একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হন বিচারপতি আনোয়ারুল হক। দুই সদস্য হন- বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দী।

আর দুই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি ওবায়দুর হাসান শাহীন এবং দুই সদস্য বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম হাইকোর্টে ফিরে যান।

এফএইচ/এমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।