আদালতেই নির্ধারিত হবে সেই শিশুটির ভাগ্য

মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল
মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০২:১৯ পিএম, ২৪ জুলাই ২০১৭

‘এই কনস্টেবল, কে আছ, উনাকে সঙ্গে নিয়ে যাও। ফাতেমাকে প্লে গ্রাউন্ডে নিয়ে এসো।’ সোমবার বিকেল ৪টায় রাজধানীর তেজগাঁও থানা কম্পাউন্ডে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের দোতলায় অফিস কক্ষে বসে এডিসি আয়শা সিদ্দিক মিলি এভাবেই একজন কনস্টেবলকে নির্দেশনা দেন।

দোতলায় প্লে গ্রাউন্ড চারপাশ লোহার শিকলে সবুজ মানি প্লান্টে ঘেরা। ভেতরে বেবী সাইকেল, কাঠের ঘোড়া ও দোলনা দিয়ে সাজানো। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি ঝরলেও প্লে গ্রাউন্ডে বৃষ্টির ছিঁটেফোটাও নেই। কারণ এর ছাদটি রঙিন প্লাস্টিক সিট দিয়ে ঢাকা। প্লাস্টিকের শিটে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শুনতে শুনতে সেই শিশুটিকে একনজর দেখার অপেক্ষা শুরু।

মিনিট কয়েক অপেক্ষার পরে অদূরের একটি কক্ষ থেকে ছোট শিশুটিকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসেন দুই পুলিশ সদস্য। শিশুটির বয়স ৭-৮ মাস। হালকা হলুদ জামা পরিহিত ফর্সা শিশুটিকে একনজর দেখলে যে কেউ বিদেশি শিশু মনে করে ভুল করতে পারে।

পুলিশ সদস্যরা কখনও কোলে কখনও বেবী সাইকেলে কখন দোলনায় দুলিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেও শিশুটির দু’চোখ অন্য কাউকে খুঁজছিল। হয়তো তার দু’চোখ জন্মধাত্রী মাকেই খুঁজছিল!

Child

বলছিলাম গত ৮ জুলাই বিমানবন্দরে ফেলে যাওয়া সেই শিশুটির কথা। গত দুই সপ্তাহ ধরে শিশুটিকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সখিনা নামে এক নারী দেখভাল করছেন। ডিসি, এডিসি, এসি, ইন্সপেক্টরসহ সবাই এতদিন অপেক্ষা করছিলেন হয়তো তার জন্মধাত্রী মা তাকে নিতে আসবেন। কিন্তু গত দুই সপ্তাহেও কেউ না আসায় আদালতের মাধ্যমে নিঃসন্তান কোনো দম্পত্তির কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান এডিসি মিলি বিশ্বাস।

কাগজে-কলমে তার নাম ফাতেমা। বাবা-মায়ের নামের স্থান শূন্য। নেই কোনো স্বজনের ঠিকানাও।

সোমবার বিকেলে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের এডিসি আয়শা সিদ্দিকা মিলি বলেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সঙ্গে অনেক এনজিও কাজ করে এবং তারা হারিয়ে বা নিখোঁজ শিশুদের শেল্টার হোমে লালন-পালন করে। কিন্তু তারা এত ছোট শিশুকে শেল্টার হোমে রাখেন না। সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানোর সুযোগ থাকলেও এত ছোট শিশুকে তিনি নিঃসন্তান কোনো দম্পত্তির কাছে হস্তান্তর করতে চান। এ পর্যন্ত তাদের কাছে সাতজন ও আদালতে একজনসহ মোট আটজন এই শিশুটিকে নেয়ার আগ্রহ ও আবেদন করেছেন। শিশুটিকে দিতে হলে আদালতের নির্দেশনা মেনে দিতে হবে।

তিনি জানান, আগামীকাল শিশুটিকে আদালতে হাজির করে কোনো নিঃসন্তান দম্পতির কাছে হস্তান্তর করা হবে, সে সম্পর্কে দিকনির্দেশনা চেয়ে আবেদন করা হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৮ জুলাই জর্ডান থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে দেশে ফিরছিলেন জয়দেবপুর নিবাসী স্বপ্না বেগম। একই বিমানে শিশুটি ও তার মাও ফিরছিলেন। স্বপ্না জর্ডানে গৃহকর্মী হিসেবে গিয়েছিলেন। অজ্ঞাত নারীও একই কাজে সেখানে গিয়েছিলেন বলে জানতে পারেন স্বপ্না। স্বপ্না বিমানবন্দর পুলিশকে জানান, ওই নারীও তার সঙ্গে জর্ডান থেকে একই ফ্লাইটে ফিরেছেন।

৮  জুলাই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে কাস্টমস থেকে মালপত্র নিয়ে বের হতে বিমানবন্দরের ক্যানওপি পার্কিং এলাকায় স্বজনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন স্বপ্না। এ সময় বিমানে পরিচয় হওয়া শিশুটির মা তাকে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, 'আপা আমার শিশুটাকে একটু ধরেন। ভেতরে মালপত্র রয়েছে, নিয়ে আসছি।' আগে কথা হওয়ায় সরল বিশ্বাসে শিশুটিকে কোলে তুলে নেন শম্পা। কিন্তু দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও সেই নারী আর ফেরেননি।

পরে স্বপ্না আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর সদস্যদের কাছে ঘটনাটি জানালে তারা বিস্তারিত শোনার পর শিশুসহ স্বপ্নাকে বিমানবন্দর থানায় পাঠায়। ওইদিনই বিমানবন্দর থানায় একটি জিডি করা হয়। এরপর শিশুটিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠানো হয়।

ধারণা করা হচ্ছে, জর্ডানে কাজে যাওয়ার পর ওই নারী সন্তান জন্ম দেন। সেখান থেকে শিশুটিকে নিয়েই তিনি দেশে ফেরেন। লোকলজ্জার ভয়ে শিশুটিকে আরেকজনের কাছে রেখে চম্পট দেন।

ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের এডিসি আয়শা সিদ্দিক মিলির কাছে শিশুটির মায়ের পরিচয় খুঁজে পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুরুর দিকে বিমানবন্দর থানা বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছে। তারা সেন্টারে কোন ভিডিও ফুটেজ দেননি। তবে স্বপ্নার করা জিডির সূত্র ধরে তারা ফ্লাইটে খোঁজ নিয়ে স্বপ্না কিংবা শিশুটির মা ও শিশুর একই ফ্লাইটে আসার কোনো প্রমাণ পাননি।

তিনি জানান, রোববার থেকে স্বপ্নার মোবাইল ফোনটি বন্ধ রয়েছে। এ ঘটনার মধ্যে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে বলে তার ধারণা।

এমইউ/জেএইচ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।