আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে জাতি আরও বিভক্ত হবে

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৭:১৬ এএম, ১৭ জুলাই ২০১৭

ড. কামাল হোসেন। বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধানপ্রণেতা। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও খ্যাতি রয়েছে আইন পেশায়। গণফোরামের সভাপতি তিনি। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। আলোচনায় গুরুত্ব পায় রাজনীতির নানা প্রসঙ্গও। চলমান সংকট উত্তরণে গুরুত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নীতি-আদর্শের ওপর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : নির্বাচন ঘিরে ফের উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?

ড. কামাল হোসেন : সংবিধানে বলা আছে, জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় জনগণের মধ্যকার প্রতিনিধি রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত থাকবেন। আর প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তিই হচ্ছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আমাদের সকল অর্জন মূলত সঠিক নির্বাচনের মধ্য দিয়েই। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জিতে মুসলিম লীগের কবর রচনা হয় এ দেশে। ওই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন পরাজিত হলেন খালেদ নওয়াজের কাছে। ফকির আব্দুল মান্নান ২৫ বছর বয়সী যুবক তাজউদ্দীন আহমদের কাছে পরাজিত হন।

এগুলোই আমাদের সামনে ইতিহাস। এ ইতিহাস আমরা ভুলে গেছি। ভুলে গেছি বলেই আজকের সংকট। ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল ৬ দফা (১৯৬৬ সাল) এবং ১১ দফার (১৯৬৯ সাল) ওপর ভিত্তি করে। ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করল।

মানুষ রায় দেয়ার সুযোগ পেলে সঠিক সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটাতে পারে।

জাগো নিউজ : এখন কী বলবেন? সিদ্ধান্ত জানানোর সুযোগ সাধারণের বাড়ল না কমল?

ড. কামাল হোসেন : আমি বিগত নির্বাচন নিয়ে এখন আর কথা বলতে চাই না। আমি চাই সামনের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হোক। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে জাতি আরও বিভক্ত হবে। এ নিয়ে কোনো দ্বিধা আছে বলে আমি মনে করি না। সাধারণ লোকেরা শতকরা একশভাগ আমার সঙ্গে একমত পোষণ করবেন।

জাগো নিউজ : সাধারণ মানুষের ওপর এমন ভরসার ভিত্তি কী?

ড. কামাল হোসেন : আপনি রাস্তায় গিয়ে সাধারণ মানুষকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করুন। দেখবেন, কেউ আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন দেখতে চায় না। সাধারণ মানুষ এখন খুবই সচেতন। কেউ আর বিভাজন চায় না। সবাই গণতান্ত্রিক সমাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই মানুষ নিরন্তর সংগ্রাম করে আসছে। এখনও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়, তাদের বিশ্বাস ও আবেগের কথা কিছুটা বুঝতে পারি। মানুষ যেমন ভাতের অধিকার চায়, তেমনি ভোটের অধিকারও চায়। গণতন্ত্রের আড়ালে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হোক তা কেউই চায় না। সবাই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। এই সাধারণ মানুষরাই বঙ্গবন্ধুর জন্য আন্দোলন করেছেন, সংগ্রাম করেছেন।

আজ নানা অজুহাতে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদের চেষ্টা হয়। অথচ বঙ্গবন্ধু বস্তিবাসীর জন্য সব সময় সচেতন থেকেছেন, তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করেছেন। আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই না। ভুলে গেছি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

জাগো নিউজ : আপনি সাধারণ মানুষের সচেতনতার কথা বলছেন। সাধারণ মানুষই লড়াই-সংগ্রামের পথ বের করেছেন। এখন কেন মানুষ জাগছে না?

ড. কামাল হোসেন : মানুষ জাগছে না, তা বলা যাবে না। মানুষ জেগে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, লড়াই-সংগ্রামে অংশ নিচ্ছে না কেন? এর জন্যও ব্যাখ্যা আছে। লড়াই-সংগ্রামের জন্য প্লাটফর্ম লাগে। কার জন্য লড়াই, কিসের জন্য লড়াই- এসব নিয়েও দ্বিধা আছে।

তবে আশার কথা হচ্ছে বাঙালি দমে থাকার জাতি না। সময়ের অপেক্ষা। আজ হোক কাল হোক সাধারণ মানুষ তার অধিকার নিয়ে রাস্তায় নামবেই।

জাগো নিউজ : বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কথা বলছিলেন। নেতৃত্বের সংকট থেকে সাধারণরা নিশ্চুপ হয়ে আছে কি না?

ড. কামাল হোসেন : আমি জনগণের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়েই আলোচনা করি। তারা যেকোনো বিষয়েই স্পষ্ট ধারণা রাখেন।

আলাদা নেতৃত্বের দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেই নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস সাধারণের হাত ধরেই জন্ম নেয়।

আমাদের কাছে না এসে গণমাধ্যমেরও উচিত সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া। তাদের বক্তব্য শোনা। সাধারণের কথা মিডিয়ায় সঠিকভাবে উপস্থাপন হয় না বলেই জাতির মাঝে আজ নানা সংকট।

আমি মনে করি নেতৃত্বের কোনো ঘাটতি নেই। তবে লড়াই-সংগ্রামের জন্য যে পরিবেশ দরকার, তার ঘাটতি আছে।

Kamal

জাগো নিউজ : আপনি আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে- এমনটি প্রত্যাশা করছিলেন। ভরসা পান?

ড. কামাল হোসেন : আর তো কোনো উপায় নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে কী সংকট তৈরি হবে তা সংবিধানে বলা আছে। সংবিধান মানলে নির্বাচন নিয়ে আর কোনো সংশয় থাকতে পারে না। আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে সংকট ভয়াবহ রূপ নেবে।

জাগো নিউজ : সংবিধানের কথা বলেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। সংকট তো ওই নির্বাচন ঘিরেই?

ড. কামাল হোসেন : সংবিধানের কারণে কোনো সংকট তৈরি হয়নি। সংবিধানের দোহাই দিয়ে বিতর্কিত নির্বাচন করে সংকট তৈরি করা হয়েছে।

আন্দোলন হওয়া উচিত সংবিধানের জন্য। সংবিধান মেনে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হোক- এমন দাবির ভিত্তিতেই সবাইকে আন্দোলন করা উচিত। সে আন্দোলন হবে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ। জ্বালাও-পোড়াও করে কোনো আন্দোলন হয় না।

জাগো নিউজ : সরকারের ভূমিকা যখন মারমুখী তখন কি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন প্রত্যাশা করা যায়?

ড. কামাল হোসেন : পাকিস্তান আমলে সরকার মারমুখী ছিল। স্বৈরাচার এরশাদের আমলেও আন্দোলন দমাতে জুলুম-নির্যাতন করা হয়েছে। আন্দোলন দেখামাত্র গুলি করা হয়েছে। তাই বলে তো আন্দোলনকারীরা সব জ্বালিয়ে দেয়নি। আবার রাজপথও ছাড়েনি। বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়েই আন্দোলন করেছে। মানুষ বিজয় লাভ করেছে।

জাগো নিউজ : সংকটের কথা বলছেন। সংকটের বিপরীতে রাষ্ট্র এগিয়েও যাচ্ছে। সরকারের মধ্যকার লোকেরা উন্নয়নকেই বড় দেখাতে চাইছেন। উন্নয়ন নিয়ে মানুষ একপ্রকার সন্তুষ্টও বটে।

ড. কামাল হোসেন : ষাটের দশকে আইয়ুব খান উন্নয়নের দশক ঘোষণা করেছিলেন। উন্নয়নের দশক পালনের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতিও নিয়েছিল আইয়ুব সরকার।

বঙ্গবন্ধু কিন্তু সেই কথিত উন্নয়নের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করেছেন। এটি তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, গণতন্ত্রের আড়ালে কোনো উন্নয়ন হতে পারে না। এমন উন্নয়ন সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।

আইয়ুব খানের উন্নয়নে ২২ পরিবার এলিট হয়েছিলেন। সাধারণের পকেট কেটে কতিপয় পরিবারের জন্য উন্নয়ন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ওই উন্নয়নের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ওই সময়ের বক্তব্য থেকেও সরকারের লোকেরা শিক্ষা নিতে পারেন।

বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ছিল সকলের উন্নয়নের জন্য। স্বাধীনতার পর সংবিধানেও বলা আছে ‘সকলের জন্যই উন্নয়ন’। কোনো বিশেষ পরিবারের উন্নয়নের কথা বলা হয়নি সংবিধানে।

এএসএস/এমএআর/জেআইএম

“মানুষ রায় দেয়ার সুযোগ পেলে সঠিক সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটাতে পারে”

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।