চিকিৎসা বিড়ম্বনায় এক দরিদ্র দগ্ধ শিশু

বিশেষ সংবাদদাতা
বিশেষ সংবাদদাতা বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৩:৪৪ পিএম, ০৮ জুলাই ২০১৭

‘ওরে মা, ওরে বাবা, মইরা গেলাম, হাতটা জ্বইল্যা যাইতাছে, আমারে তাড়াতাড়ি বাড়িত লইয়া যাও, নাইলে আমারে মাইরা ফালাও।’

শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগসংলগ্ন বার্ন ইউনিটের সামনে আনুমানিক পাঁচ বছরের এক শিশু এভাবেই ক্রমাগত আর্তনাদ করছিল।

শিশুটির হাত ও পশ্চাদদেশে দগদগে ঝলসানো পোড়া দাগ। শিশুটির রিকশাচালক বাবা বারবার পোড়া দাগে ফুঁ দিয়ে বাতাস দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। ফুঁ দিয়ে যতই যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টা করছিলেন তত বেশি জোরে কেঁদে উঠছিল শিশুটি।

burn

রিকশার সিটে তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে বসে কাঁদছিলেন ওই শিশুর মা। পাশের সিটে প্লাস্টিকের বোল, চেয়ার ও একটি ব্যাগ হাতে অসহায় দৃষ্টিতে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল তার বোন।

শিশুটির ক্রমাগত আর্তনাদ ও ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ না করে ফিরে যাচ্ছে দেখে জরুরি বিভাগের সামনে থেকে অনেকেই ছুটে এসে সমবেদনা প্রকাশ করে রিকশাচালক দম্পতিকে ভর্ৎসনা করতে থাকেন।

কৌতূহলবশত এ প্রতিবেদকও সেখানে এগিয়ে গেলে রিকশাচালক আনিস জানান, স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর ধলপুরে থাকেন। সম্প্রতি রান্নাঘরে গ্যাসের চুলায় পানি গরম করতে দিয়ে তার স্ত্রী অন্য কক্ষে গেলে শিশুটি পানির ডেকচির কাছে যায়। এ সময় ডেকচি উল্টে গরম পানি পড়ে তার হাত ও পশ্চাদদেশ মারাত্মকভাবে ঝলসে যায়।

burn

ওই সময় বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসা হলে চিকিৎসা দিয়ে পড়ে আসতে বলেন চিকিৎসকরা। কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও ক্ষতস্থান না শুকানোয় শনিবার বার্ন ইউনিটে আবার আসেন বাবা-মা। শিশুটির মা জানান, ডাক্তারের কক্ষে প্রবেশের পর তিনি পুরনো সিলিপ (প্রেসক্রিপশন) দেখতে চান। সিলিপ হারিয়ে ফেলেছেন শুনতেই রেগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বের করে দেন।

এ সময় ছেলের ক্ষতস্থান দেখিয়ে বারবার চিকিৎসা দেয়ার অনুরোধ করা হলেও চিকিৎসক কর্ণপাত করেননি। বার্ন ইউনিটে জরুরি বিভাগের অনেককে অনুরোধ করলেও সিলিপ ছাড়া কেউ চিকিৎসা করবেন না বলে জানিয়ে দেন।

দগদগে ক্ষত নিয়ে বাসায় গেলে কী চিকিৎসা করাবেন জানতে চাইলে শিশুটির মা অসহায়ের মতো তাকিয়ে থেকে বলেন, ‘গরিব মানুষ, বাসার সামনের ডিসপেনসারি থাইক্যা ঘা শুকানির মলম কিন্যা লাগামো, এছাড়া আর কী করার আছে।’

burn

ঢামেক বার্ন ইউনিট দেশের পোড়া রোগের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা পোড়া রোগীদের চিকিৎসা দেন। হাসপাতালের পরিচালকসহ চিকিৎসকরা সবসময় দাবি করেন এখানে রোগীরা বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধপত্র পায়।

এ বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ে এ প্রতিবেদক পোড়া শিশু ও তার মাকে নিয়ে জরুরি বিভাগে যান। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর ভেতর থেকে ডাক আসে। ভেতরে গিয়ে আজ সকালে কেনা নতুন টিকিট দেখাতেই ডাক্তার ধমকে উঠে বলেন, আবার কেন এসেছেন?

এ সময় এ প্রতিবেদক বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ জানালে তিনি অনুরোধে ঢেকি গেলার মতো করে বলেন, ‘পুরনো প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ দিতে হলে নতুন প্রেসক্রিপশনে আবাসিক চিকিৎসকের অনুমতি ও স্বাক্ষর লাগবে।’

burn

তার কথামতো আবাসিক চিকিৎসকের কক্ষে গিয়ে কক্ষটি তালাবদ্ধ দেখতে পাওয়া যায়। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এমএলএসএস বলেন, ‘স্যার জরুরি কাজে বাইরে গেছেন, অপেক্ষা করেন।’

এ সময় মিনিট ১৫ দাঁড়িয়ে থেকে আবার ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি উপদেশের সুরে বলেন, ‘আরএসের অনুমতি ছাড়া এভাবে চিকিৎসা দেয়া যায় না। যান ওষুধ লিখে দিচ্ছি। পাশের রুমে যান।’

জরুরি বিভাগের ড্রেসিং রুমে যেতেই দেখা যায় কর্তব্যরত নার্স ও একজন এমএলএসএস সিঙ্গারা খাচ্ছেন। মুখে সিঙ্গারা রেখেই এমএলএসএস জানান, ড্রেসিং করার আগে ভোলটারিন সাপোজিটরি দিতে হবে। তাদের এখানে সাপ্লাই নেই। বাইরে থেকে কিনে আনতে হবে।

burn

এ সময় শিশুটির মা বাইরে ছুটে গিয়ে ভোলটারিন কিনে আনেন। এরপর শুরু হয় অপেক্ষার পালা। অন্যান্য রোগীর ড্রেসিং করা হলেও শিশুটির দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। এভাবেই কেটে যায় আরও ৩০ মিনিট। ক্ষণে ক্ষণে ব্যথায় কুকড়ে উঠে কাঁদতে থাকে শিশুটি।

একপর্যায়ে মানিক নামের একজন এমএলএসএসকে ডেকে এ প্রতিবেদক তার পরিচয় দিয়ে শিশুটিকে কেন ড্রেসিং করা হচ্ছে না জানতে চাইলে নার্স ইনচার্জ স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেন, আগে অন্য রোগীর চিকিৎসা পরে সিলিপ ছাড়া রোগীর চিকিৎসা। এ কথার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর চাইতে সিরিয়াস রোগীর ড্রেসিং করতেই এ কথা বলেছেন বলে ব্যাখ্যা দেন।

বেলা আনুমানিক দেড়টায় চিকিৎসা বিড়ম্বনার অবসান হয়। একজন নার্স সযত্নে হাতে ও পশ্চাদদেশে সিল ক্রিম মেখে সুন্দর করে ব্যান্ডেজ করে দেন। এবার কান্না থামে শিশুটির। আসার সময় ফের মঙ্গলবার এখানে এসে দেখা করার পরামর্শ দেন।

চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাওয়ার পথে এ প্রতিবেদকের সামান্য সাহায্যে ছেলের চিকিৎসা পেয়ে কৃতজ্ঞতায় চোখের পানি ফেলেন মা। শাওন ও তার মাকে উদ্দেশ্য করে এ প্রতিবেদক বলেন, অনেকক্ষণ তো মা-ছেলের কান্না দেখলাম, এবার হাসি মুখটা দেখতে চাই। এ কথা বলতেই উপকারের ঋণ শোধ করতে আনন্দে হেসে ওঠেন দুজনই।

এমইউ/বিএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।