ষাটোর্ধ্ব অভিমানী এক নারী রিকশাচালকের গল্প


প্রকাশিত: ১২:৩০ পিএম, ০৫ জুলাই ২০১৭

‘আল্লাহর দোহাই লাগে। আপনে আমার পিছু ছাড়েন। আমার পোলা আছে, মাইয়া আছে, অনেক আত্মীয়-স্বজনও আছে। তারা কেউ জানে না আমি রিকশা চালাই। মাইয়া মানুষ রিকশা চালায় শুনলে মানুষ খারাপ কইবো। আমার কারণে সমাজে তাদের মাথা নিচু হোক তা চাই না। তবে কারও দয়া করুণায় বাঁচতে চাই না। হের লাইগ্যা কষ্ট কইরা রিকশা চালাইয়া জীবন চালাই।’

বুধবার বেলা আনুমানিক ১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-২ এর অদূরে চাঁনখারপুলের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অভিমানি কণ্ঠে প্রায় এক নিঃশ্বাসে এসব কথা বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধা অটোরিকশাচালক। আপনার নাম কি, কোথায় থাকেন, কেন রিকশা চালাচ্ছেন, কত দিন চালাচ্ছেন, সন্তানাদি থাকতেও কেন বৃদ্ধ বয়সে রিকশা চালাচ্ছেন এসব প্রশ্ন করতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছিলেন।

প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ক্রোধ মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, ‘রোজা রাখছি, দয়া কইরা কিছু জিগাইয়েন না। আপনি যান।’ এসব কথোপকথনের আধা ঘণ্টা আগে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধার সন্ধান পান।

দুপুর তখন সাড়ে ১২টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে রোগীদের ভিড়। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি ঝরছে। অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও প্যাডেলচালিত রিকশা এসে ক্ষণে ক্ষণে জরুরি বিভাগের সামনে রোগী নামাচ্ছিল।

ricksha

হঠাৎ করেই ব্যাটারিচালিত একটি অটোরিকশা এসে জরুরি বিভাগের সামনে থামল। রোগী নামিয়ে হাত বাড়িয়ে ভাড়া নিলেও কোনো কথা বলতে দেখা গেল না। এ প্রতিবেদক কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন এই রিকশাচালকের বেশভূষা আর দশজন রিকশাচালকের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন।

পরনে কালো রঙের ঢিলেঢালা ফুল প্যান্ট, ফুল স্লিপ প্রিন্টেড শার্ট, মাথায় গামছা বাঁধা ও ক্যাপ, মুখে মাস্ক, গলায় গামছা, পায়ে কালো রঙের মোজা ও কালো প্লাস্টিকের স্যান্ডেল।

একটু লক্ষ্য করতেই বোঝা গেল তিনি পুরুষ নন, নারী রিকশাচালক। বিশেষ করে মাথায় গামছা ও মুখে মাস্ক পরলেও কানের পাশের পাকা চুল ও বয়সের ভারে কুঁচকানো দু’হাত দেখে সহজেই বোঝা যাচ্ছিল বৃদ্ধার বয়স আনুমানিক ৬০-৬৫ বছর।

জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক কৌতূহলী হয়ে সামনে গিয়ে নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই তার নাম খাদিজা ও ধলপুর এলাকার বাসিন্দা বলে জানান। গণমাধ্যমের কর্মী পরিচয়ে বৃদ্ধ বয়সে রিকশা চালানোর নেপথ্যের কারণ জানতে চেয়ে বৃদ্ধাকে দু-চারটি প্রশ্ন করতেই তিনি চটে গেলেন। কোনো কথা বলবেন না জানিয়ে রিকশা নিয়ে দে ছুট।

নাছোড়বান্দা এ প্রতিবেদকও তার পিছু ছোটেন। জরুরি বিভাগ থেকে বেরিয়ে বহির্বিভাগ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, টিএসসি, জগন্নাথ হল ও বকশিবাজার মোড় হয়ে চাঁনখারপুলের সামনে বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে গেলে যানজটে আটকা পড়েন ওই বৃদ্ধা রিকশাচালক।

ricksha

এ বৃদ্ধ বয়সে ছেলে মেয়েরা বাবা-মাকে দেখবে এটাইতো সবাই আশা করে এমন প্রশ্ন করলে বৃদ্ধা বলেন, ‘যাইয়া দেহেন এ বয়সে কত মাইনষে কষ্ট করতাছে। বললেন, ইন্নালাহে মা ছাবেরিন। সবাই কি কোটিপতি। সবাই বড়লোক হইলে আল্লাহরে ডাকবে কেডা, কষ্ট করবে কেডা।’

‘আপনি তো চুরি করছেন না, রিকশা চালাচ্ছেন তবে কেন কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছেন’ এ প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধা বলেন, ‘এ সমাজে মহিলা রিকশা চালালে মানুষ তা ভালো চোখে দেখেন না। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন এখন ভালো কাজ কি জানেন? না সূচক জবাব দিলে তিনি বলেন, ‘চুরি করা, মানুষরে ঠকানোই এখন ভালো কাজ। এখন কর্মকে মানুষ দাম দেয় না।’

কতদিন ধরে রিকশা চালাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি ক্ষেপে উঠে বলেন, ‘ঈদের পরে ছয় রোজা করতাছি, আইজও রোজা রাখছি, বেশি কতা কইতে ভাল লাগে না।’ রিকশা চালিয়ে রোজা রাখতে পারছেন এমন কথা বললে তিনি বলেনন, ‘শুধু এই ছয় রোজাই না, রমজানে ৩০ রোজা রেখেছেন, পাঁচ ওয়াক্তসহ তারাবির নামাজ পড়েছেন, একবার কোরআন শরিফ খতম দিয়ে আরও এক পারা কোরআন শরিফ পড়েছেন আবার প্রতিদিন তিন-চার ঘণ্টা রিকশাও চালিয়েছেন বলে জানান।’

বৃদ্ধার কোনো ধরনের সাহায্য লাগবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দোয়া কইরেন যেন হালাল রোজগার খাইয়া মরতে পারি।’ চলে যাওয়ার সময় একটি ভিজিটিং কার্ড দিলে প্রয়োজনে তিনি নিজেই যোগাযোগ করবেন বলে জানিয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে যান।

এমইউ/ওআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।