গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম-মারজানসহ ৩৫ জঙ্গি নিহত


প্রকাশিত: ০১:৪৪ পিএম, ৩০ জুন ২০১৭

গত বছর দেশ-বিদেশ তোলপাড় করা ঘটনার একটি ঢাকার কূটনৈতিক এলাকা গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা। ওই হামলার পর ঘোষণা দিয়ে জঙ্গি দমনে মাঠে নামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এরপর একে একে আবিষ্কৃত সব জঙ্গি আস্তানা গুঁড়িয়ে দিতে থাকে তারা।

এ সব অভিযানে গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড (পরিকল্পনাকারী) এবং নব্য জেএমবি নেতা তামিম চৌধুরী ও মারজানসহ মারা যায় ৩৪ জঙ্গি।

র‌্যাব ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পরে ঢাকার কল্যাণপুর, রূপনগর, আজিমপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও র‌্যাব। এ সময় জঙ্গিদের হামলায় চার পুলিশ সদস্য, র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধান ও ফায়ার সার্ভিসের এক সদস্য মারা গেছেন।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম সূত্র জানায়, পুরাতন জেএমবিকে নতুন করে পরিচালনায় এগিয়ে আসেন কানাডা ফেরত জঙ্গি তামিম চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম মারজান। এ দুজনই মূলত: গুলশান হামলার পরিকল্পনাকারী।

র‌্যাব ও পুলিশ সূত্র জানায়, গুলশান হামলার পর নড়েচড়ে বসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুরু হয় জঙ্গি বিরোধী অভিযান। একের পর এক অভিযানে তছনছ হয়ে যেতে থাকে জঙ্গি আস্তানা ও জঙ্গি নেটওয়ার্ক। জঙ্গি হামলার মাস্টারমাইন্ড, অস্ত্রদাতা, অর্থদাতা, প্রশিক্ষণ-প্রশিক্ষক ও তাদের আশ্রয়দাতাদের সনাক্ত করা হয়। তদন্তে উঠে আসে নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়ানো উগ্রপন্থি সংগঠন নিউ জেএমবি।

গত বছরের ৫ আগস্ট র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শফিউল ও তার সহযোগী আবু মোকাতিল নামে দুই সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়। গত বছরের গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় পরিচালিত হয় ‘অপারেশন স্টর্ম। এতে নিহত হয় ৯ জঙ্গি।

গত ২৭ আগস্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। ওই অভিযানে নিহত হয় নব্য জেএমবি নেতা ও গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী। এ সময় তামিমের সঙ্গে মারা যায় দুই সহযোগী ধানমণ্ডির তওসিফ হোসেন ও যশোরের ফজলে রাব্বী।

কে এই তামিম আহমেদ চৌধুরী?

গুলশান হামলার অন্যতম ‘মাস্টারমাইন্ড’ তামিম আহমেদ চৌধুরীরর জন্ম কানাডায়। পৈতৃক বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারে। কানাডার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের দাবি তামিমের আরেক নাম শেখ আবু ইব্রাহীম, তিনি ইসলামিক স্টেট (আইএস) বাংলাদেশের প্রধান ছিলেন।

কানাডায় থাকাকালীন পুলিশি হয়রানির অভিযোগ তুলে তামিম বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তারপরই সরাসরি আইএসের হয়ে নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা করতে থাকেন। লেবানন থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্রেও একই দাবি করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর দুবাই থেকে ইত্তেহাদ এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে বাংলাদেশে আসেন তিন সন্তানের জনক তামিম।

আইএস মুখপাত্র বলে পরিচিত ‘দাবিক’ ম্যাগাজিনের ১৪তম সংখ্যায় তামিমকে আইএসের বাংলাদেশ প্রধান দাবি করা হয়েছিল। এর পরপরই ঢাকার গুলশান ও কিশোরগঞ্জে হামলা হয়।

গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে মিরপুরের রূপনগরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানকালে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হয় জাহিদুল ইসলাম নামে অবসরপ্রাপ্ত এক মেজর। নিহতের আঙুলের ছাপ মিলিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে জানা গেছে তার নাম মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, পিতা মো. নুরুল ইসলাম, বাড়ি কুমিল্লায়।

তিনি জেএমবির সামরিক শাখার গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা ছিলেন বলে জানান কানউন্টার টেরোরিজম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম। নারায়ণগঞ্জে তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর নব্য জেএমবিতে তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথছিল মুরাদ ওরফে মেজর মুরাদ ওরফে জাহিদুলের।

এক সপ্তাহ পর ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরের একটি বাড়িতে আরেক অভিযানে নিহত হন নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা ও আশ্রয়দাতা তানভীর কাদেরী। সেখান থেকে আটক করা হয় তিন নারী জঙ্গি ও তানভীরের ১৪ বছর বয়সী ছেলেকে।

ওই বছরের ৮ অক্টোবর পুলিশ ও র‌্যাব গাজীপুর, আশুলিয়া ও টাঙ্গাইলের চার আস্তানায় অভিযান চালায়। গাজীপুরে পৃথক দুই অভিযানে ৯ জঙ্গি, টাঙ্গাইলে দুই জঙ্গি এবং আশুলিয়ায় নিহত হন জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা।

gulsan

চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি দিবাগত রাতে মোহাম্মদপুরে পুলিশের সঙ্গে এক বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড জঙ্গি মারজান। তার পুরো নাম নুরুল ইসলাম মারজান। তিনি নব্য জেএমবির অপারেশন কমান্ডার ছিলেন।

কে এই মারজান

নুরুল ইসলাম মারজানের বাড়ি পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের আফুরিয়া গ্রামে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের ছাত্র। ২০১৬ সালে জানুয়ারিতে বিয়ে করে বাড়িছাড়া হন। সেই থেকে পরিবারের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না। মো. নাজিম উদ্দিন ও সালমা খাতুনের ১০ সন্তানের মধ্যে মারজান চতুর্থ। আনুমানিক বয়স ২২-২৩ বছর। পুলিশের তদন্তে গুলশান হামলার ‘অপারেশন কমান্ডার’ হিসেবে মারজানকে শনাক্ত করা হয়।

গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে তিনি পাবনা শহরের পুরাতন বাঁশবাজার আহলে হাদিস কওমী মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি পাবনা আলিয়া মাদরাসা থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে দাখিল ও আলিম পাস করেন। এরপর ২০১৪ সালে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে শেষবারের মতো বাড়ি গিয়েছিলেন। তখন খালাতো বোন প্রিয়তিকে বিয়ে করেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফাহাদ নামে পরিচিত ছিলেন মারজান। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় সিজিপিএ ৩.৪৮ পেয়ে দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হন। এরপর ২০১৫ সালে দ্বিতীয় বর্ষের ছয়টি কোর্সের পরীক্ষা দিলেও বাকি পরীক্ষায় আর অংশ নেননি।

চলতি বছরের গত ১৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইল থেকে হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম ‘পরিকল্পনাকারী’ জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীকে গ্রেফতার করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তিনি রাজীব, সুবাশ গান্ধী, রাজীব গান্ধী ও গান্ধী নামেও পরিচিতি।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, তিনি উত্তরাঞ্চলের জঙ্গি কমান্ডার হিসেবে কাজ করতেন। গুলশান হামলা সংগঠনের জন্য অভিজ্ঞ জঙ্গির প্রয়োজন ছিল। রাজীব গান্ধী গুলশানের জন্য ২ জন ও শোলাকিয়ার জন্য ১ জন জঙ্গি সংগ্রহ করেন।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে গত এক বছরে অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছি। এ মামলায় সরাসরি জড়িতদের কেউ জীবিত নাই।

তিনি জানান, এর বাইরে পরিকল্পনা ও সহযোগিতাসহ নানাভাবে যারা ভূমিকা রেখেছে তাদেরও চিহ্নিত করা হয়। গত এক বছরে পরিচালিত অভিযানে হলি আর্টিসান হামলায় জড়িত ৮ জন নিহত হয়েছে। আরও ৪ জন গ্রেফতার রয়েছে। এদের মধ্যে তিনজন নিজেদের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে।

হলি আর্টিসানে নিহত ভিকটিমদের ময়না তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছি। তবে আসামীদের ময়না তদন্ত প্রতিবেদন এখনো পাইনি। পাশাপাশি মামলার তদন্তভার আমরা অনেকটাই গুছিয়ে এনেছি। এই বছরের মধ্য মামলার তদন্তভার শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

উল্লেখ্য, নব্য জেএমবি সদস্যরা রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকা গুলশান টার্গেট করে গত বছরের ১লা জুলাই রাতে হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় হামলা চালায়। হামলায় দেশি-বিদেশি ২০ জন এবং দুই পুলিশ সদস্য নিহত হন। ওই রাতেই ইসলামিক স্টেট (আইএস) এই হামলার দায় স্বীকার করে।

নিহত বিদেশিদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি ও একজন ভারতের নাগরিক। বাকি তিনজন বাংলাদেশি। নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তা হলেন ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার তৎকালীন ওসি সালাহউদ্দিন।

পরদিন সকালে সেনা কমান্ডো পরিচালিত অপারেশন থান্ডার বোল্টে রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সাবিহ মোবাশ্বের, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল নামে ৫ জঙ্গি মারা যায়।

জেইউ/এমএমজেড/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।