সেদিন থমকে ছিল ঢাকা
একটি রাতের গল্প। রক্তের হলিখেলায় যে গল্পের শুরু, রক্তের গঙ্গাস্রোতেই সে গল্পের শেষ। যে গল্পের আর্তনাদে আজও কেঁপে ওঠে ধরণী।
১ জুলাই। যেন এক অভিশপ্ত রজনীর মন্দ উপাখ্যান। যে উপাখ্যানে ‘মৃত্যু’-ই মূল উপজীব্য। যুগে যুগে যেসব উপাখ্যানে মানবতাকে পরাজিত হতে দেখেছে সভ্যতা, এ দিন রাতেও তাই দেখেছে রাজধানীবাসী। মানবের কাছে মানবের নৃশংস এ পরাজয় ছিল বিশ্ব ইতিহাসের এক কলঙ্ক অধ্যায়।
হলি আর্টিসান হামলার প্রথম বর্ষপূর্তি আজ। বর্বর সেই হত্যাকাণ্ডের বছর পেরুলেও মনের দাগ কাটেনি কারোই। ঘটনার পর ঘটনা ঘটেছে বহু। ঘটনাতেই চাপা পড়ছে ঘটনা। তবে কোনো ঘটনাই চাপা দিতে পারেনি হলি আর্টিজানের নৃশংসতা।
সে দিন শুক্রবারের সন্ধ্যাবেলার কথা। রমজানের সন্ধ্যা বলে রাজধানীর সড়কগুলো ছিল খানিক ফাঁকা। যারা বেরিয়েছিলেন, তাদের বেশির ভাগই ঈদের কেনাকাটায়। ঐদিন সন্ধ্যালগ্ন পেরিয়ে যে আঁধার নেমেছিল রাজধানীতে, তা ঘনীভূত হয় পরের দিন ভোরের আলোতেও।
রাজধানী ঢাকার গুলশান অ্যাটাক। গুলশান লেকের ধারে ছোট্ট একটি রেস্টুরেন্ট হলি আর্টিসান। কূটনীতিক পাড়ায় এ রেস্টুরেন্টে বিদেশিদের আনাগোনাই ছিল বেশি। পরিপাটি এবং মনোরম পরিবেশে হওয়ায় রেস্টুরেন্টটিতে অভিজাত শ্রেণির কাছে ছিল বেশ পরিচিতও।
আর এ কারণেই জঙ্গিদের টার্গেটে পরিণত হয় হলি আর্টিসান। স্বল্প শক্তি ক্ষয়ে অধিক ফল পাওয়ার যে পরিকল্পনা নিয়েছিল জঙ্গিরা তাতে ষোলো কলাই পূর্ণ হয় তাদের।
ঘটনার শুরু গুলশানের ৭৯ নং সড়কের পুলিশের চেকপোস্ট থেকে। পুলিশের বাধা পেলেও ফাঁকা গুলি করে চৌকি পার হয়ে হামলাকারীরা দ্রুত ঢুকে পড়ে হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টে ঢুকেই জিম্মি করে ফেলে অবস্থানরত সবাইকে। জিম্মির এ ঘটনা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। জিম্মিদের উদ্ধারে প্রথমে চলে পুলিশের অপরিপক্ক অভিযান। এতে করে হামলাকারিদের গুলিতে মারা যায় পুলিশের দুই কর্মকর্তা। আহত হয় আরও জনা পঁচিশেক পুলিশ সদস্য। পুলিশ কর্তাদের নিহতদের ঘটনায় হামলার ভয়াবহতা তখন আচঁ করতে পারেন সবাই।
এরপর ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজধানীজুড়েই। পুলিশের বাড়তি নিরাপত্তা জোরদার করা হয় সব পয়েন্টে। গুলশান এলাকায় চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় ঘটনার পর থেকেই। আতঙ্কে রাজধানীবাসীর পথ আর সরছিল না। যেন অঘোষিত কার্ফু রাজধানীজুড়ে। সবার চোখ তখন গণমাধ্যমে। খবর ছুড়িয়ে পড়ে বিশ্বমিডিয়াতেও।
কিন্তু রাতের আঁধারের মতোই তখন হলি আর্টিসানের খবর আঁধারে থেকে যায়। কি হচ্ছে ভেতরে? কারা হামলা করেছে? জিম্মিরা বেঁচে, নাকি মৃত-এসবের কোনোই হদিস মিলছিল না।
সময় গড়াচ্ছে, বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও। শত শত র্যাব-পুলিশের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল হামলাকারীদের শক্তির ব্যাপকতা। মাত্র ত্রিশ গজ দূরে অবস্থান করলেও হলি আর্টিসানে অভিযানে সাহস পাচ্ছিল না র্যাব-পুলিশেরা। হলি আর্টিসান ঘিরে রাখা র্যাব-পুলিশের মাঝেও উদ্বেগের কমতি ছিল না।
হামলার বিষয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও মধ্যরাতে আতঙ্ক চরমে রূপ নেয় যখন আইএস কর্তৃপক্ষ সাইট ইন্টিলিজেন্সে প্রকাশ করে যে, তাদের সদস্যরাই গুলশানে হামলা করেছে। বাংলাদেশ সরকার স্বীকার না করলেও বিশ্বগণমাধ্যমে আইএস-এর সংবাদ প্রকাশের পর ঘটনার গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।
রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসেন বাহিনীর প্রধানগণ। সিদ্ধান্ত হয় সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর অভিযান পরিচালনার। রাতেই সিলেট থেকে প্যারা কমান্ডো বাহিনীর সদস্যদের ঢাকায় আনা হয়। প্রস্তুতি চলে অপারেশন ‘থান্ডার্ড বোল্ট’-এর। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌ-বিমান বাহিনী, র্যাব-পুলিশ-বিজিবি’র যৌথ অভিযান প্রক্রিয়া শুরু হয় পরের দিন সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ। ৭ টা ৪৫ মিনিটে চূড়ান্ত অভিযান শুরু হয়।
কমান্ডো অভিযানে গুলি, গ্রেনেড আর বোমার বিস্ফোরণ প্রকম্পিত হতে থাকে গুলশান। কেঁপে ওঠে রাজধানী। অভিযানের ১০ মিনিটের মধ্যেই (৯ টা ৫৫ মিনিট) হলি আর্টিসান ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় কমান্ডো বাহিনী। ৯টা ১৫ মিনিটে অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
এরপরেই চলে লাশ গণনার পালা। জঙ্গিদের হামলা এবং কমান্ডো বাহিনীর অভিযানে ২২ জন দেশি-বিদেশি নাগরিক এবং ৫ জঙ্গি নিহত হয়। এছাড়া ওই ঘটনায় রেস্টুরেন্টের একজ শেফ এবং পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজন মারা যান। হলি আর্টিসান হামলায় নিহতদের মধ্যে ১৭ জনই ছিল বিদেশি নাগরিক।
টানা ১২ ঘণ্টা শ্বাসরুদ্ধকর এ ঘটনায় থমকে যায় দেশ, স্তব্ধ হয়ে পড়ে জাতি। হতবাক হয় বিশ্ব। এ ঘটনায় পাল্টে যায় দেশে জঙ্গিবাদের হিসাব-নিকাশও।
এএসএস/জেএইচ/পিআর