ভেন্টিলেশন সাপোর্ট কি খুলে ফেলব?
রোগিণীর মৃত্যু ঘোষণার পর হাসপাতালের বিল পরিশোধ করে মরদেহ গ্রহণ করতে বলা হলো স্বজনদের। মৃতের স্বামী বিল পরিশোধ করে আইসিইউতে এলেন। এমন সময় নার্স বললেন, ‘ভেন্টিলেশন সাপোর্ট কি খুলে ফেলব?’ যদিও এর আধা ঘণ্টা আগে রোগিণীকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
এ কথা শুনে স্বামী হতবাক হয়ে নার্সের দিকে তাকিয়ে বলেন, তার মানে এখনও আমার স্ত্রী মারা যায়নি। এর উত্তরে নার্স বলেন, চিকিৎসক সাহেবের সঙ্গে কথা বলে দেখি। একথা বলে নার্স ভেতরে চলে গেলেন। হাসপাতালের আইসিইউ’র গেটে দাঁড়িয়ে কর্তব্যরত নার্সের ভেতরে চলে যাওয়া নির্বাক তাকিয়ে দেখলেন নীলক্ষেতের (১৪ রোডের) বাসিন্দা মো. মানিক।
এ ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানীর ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে।
সোমবার বিকেল থেকে এ হাসপাতালের আইসিইউ’র ছয় নম্বর বেডে অধ্যাপক ডা. এ কে খন্দকারের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন তার স্ত্রী ৫২ বছর বয়সী আকতার জাহান (ভর্তি রেজিস্টেশন নম্বর-০৬৪০৯১১৭)।
স্ত্রীর মাত্র ৩০ ঘণ্টার চিকিৎসায় ৮৬ হাজার ১৮৭ টাকা বিল পরিশোধ করেছেন এই হতভাগা স্বামী।
জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে মানিক মিয়া জানান, সোমবার হাসপাতালে আনার পরপরই আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে শুধু বিলের পর বিলে স্বাক্ষর করানো হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলেই রোগীর অবস্থা ভালো নয় বলা হয়। একপর্যায়ে বলা হয় রোগী হার্ট অ্যাটাক করেছে। তার কার্ডিয়াক আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন। এ হাসপাতালে তা নেই।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে মো. মানিক অভিযোগ করেন, আইসিইউতে আট থেকে দশজন মুমূর্ষু রোগী থাকলেও সোমবার থেকে মাত্র একজন চিকিৎসক ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ‘৮৬ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করেছেন এ নিয়ে তার দুঃখ নেই। কিন্তু আইসিইউর মতো স্পর্শকাতর ওয়ার্ডে মাত্র একজন ডাক্তার দিয়ে তার স্ত্রী উপযুক্ত চিকিৎসা পেয়েছে কি না তা নিয়ে মনে সন্দেহ রয়ে গেছে। এগুলো দেখার কি কেউ নেই? প্রশ্ন রাখলেন তিনি।’
হাসপাতালের বিলে দেখা যায়, ২৬ জুন বিকেল ৩টা ৪৪ মিনিটে আকতার জাহানকে ভর্তি করা হয়। ২৭ জুন ৯টা ২ মিনিটে রিলিজ দেখানো হয়। দুটো অংশে বিল করা হয়। আইটেমস উইথ সার্ভিস চার্জ ও আইটেম উইথআউট সার্ভিস চার্জ।
প্রথম অংশের বিলে দেখা যায়, রোগীর ভর্তি ফি ধরা হয়েছে ৮শ’ টাকা। ৩০ ঘণ্টা আইসিইউ’র বেড ব্যবহৃত হলেও দুদিনের ভাড়া হিসেবে ১৪ হাজার টাকা ধরা হয়। এছাড়া আইসিইউ খাতে ২০ হাজার ১৫০ টাকাসহ ৩৪ হাজার ৯৫০ টাকা বিল ধরা হয়। এ বিলের ওপর শতকরা ৮ শতাংশ সার্ভিস চার্জসহ মোট ৩৭ হাজার ৭৪৬ টাকা বিল ধরা হয়।
দ্বিতীয় অংশে আইসিইউতে ৩০ ঘণ্টা চিকিৎসাধীন সময়ে ওষুধ বাবদ ৩০ হাজার ৭২১ টাকা বিল করা হয়। এছাড়া আইসিইউতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ ১৪ হাজার ১২০ টাকা ধরা হয়। এর বাইরে তিনজন বিশেষজ্ঞের ভিজিট ১ হাজার ২শ’ টাকা হিসেবে ৩ হাজার ৬শ’ টাকা ধরা হয়।
ওষুধের তালিকায় দেখা যায়, প্রথমদিন ৬৭ ধরনের ও পরদিন ৪৫ ধরনের ওষুধ ও ইনজেকশন দেয়া হয়।
৩০ ঘণ্টার চিকিৎসায় দুদিনের বেড ভাড়া কেন ধরা হলো জানতে চাইলে বিলিং অফিসার মাসুদ রানা জানান, তাদের এখানে আবাসিক হোটেলের মতো ১২টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ভাড়া ধরা হয়। বিলের ওপর শতকরা ৮ শতাংশ সার্ভিস চার্জও রয়েছে।
রোগী আকতার জাহানের ছোট ভাই শুক্কুর মাহমুদ অভিযোগ করেন, সোমবার রাতে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন তাদের এখানে কার্ডিয়াক আইসিইউ সাপোর্ট নেই। তাই যেখানে এসব সাপোর্ট রয়েছে তারা চাইলে সেখানে নিয়ে যেতে পারেন।
তিনি বলেন, সকাল ৯টা থেকে তারা অন্যত্র নেয়ার জন্য রোগীর কেস সামারি চাইতে থাকেন। একাধিকবার কেস সামারির জন্য তাগাদা দেয়া হলেও চিকিৎসক একা, ভেতরে আটজন রোগী দেখছেন, ফাঁকে ফাঁকে লিখছেন বলে সময়ক্ষেপণ করে বেলা ২টার পর কেস সামারি দেন। সেখানে তিনি ভুল তথ্য দিয়েছেন। ইতোপূর্বেও রোগিণী পপুলার হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করলেও তিনি ওই কাগজে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে লিখেছেন।
চিকিৎসক গত রাত থেকে মারাত্মক ধরনের কার্ডিয়াক সমস্যার কথা বললেও যে কেস সামারি দিয়েছেন তা নিয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকদের দেখালেও তারা বলেন, রোগিণীর হার্টের মারাত্মক সমস্যা রয়েছে তা কেস সামারি দেখে বোঝা যায় না।
মো. মানিক বলেন, গত দুদিন ধরে শুধু এই বিল সেই বিলে স্বাক্ষরই করে গেলাম, টাকা খরচ করেও যদি স্ত্রীকে বাঁচাতে পারতাম তাও দুঃখ ছিল না। এ ব্যাপারে কি কেউ দেখার নেই বলে জানতে চান তিনি।
জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক অধ্যাপক ডা. এ কে খন্দকারের কাছে রোগিণীর স্বজনদের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেস হিস্ট্রিতেই রোগিণী আগে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি থাকার তথ্য পেয়েছেন। সোমবার রোগিণীর মারাত্মক ধরনের হার্ট অ্যাটাক হয়। কিছু সময়ের জন্য হার্ট বন্ধ হয়ে যায়। কারেন্ট শকড দিয়ে হার্টবিট ফিরিয়ে আনা হয়। তারা রোগিণীকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও রোগীর স্বজনরা নেয়নি। তারা রোগিণীকে বাঁচাতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোগিণী মারা যায়।
সকালে কেস সামারি চাইলে দুপুরে কেন দেয়া হলো এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণত ২৪ ঘণ্টা অবজারবেশনে রেখে তারপর কেস সামারি লেখা হয়। তবে ঈদের ছুটিতে একা ডিউটিতে থাকায় কিছুটা বিলম্ব হয় বলে স্বীকার করেন তিনি ।
এমইউ/জেডএ