ইন্ডিয়া-চীনের টানাপোড়েনে বাংলাদেশ জিম্মি হয়ে পড়ছে


প্রকাশিত: ০৩:৫৫ পিএম, ৩১ মে ২০১৭

অধ্যাপক আবু আহমেদ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। দেশের চলমান অর্থনীতি নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র।

আলোচনায় গুরুত্ব পায় অর্থপাচার, খেলাপি ঋণ, ব্যাংক-বীমা, আসন্ন বাজেট ও নতুন ভ্যাটনীতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ। আলোচনা প্রসঙ্গে উঠে আসে রাজনীতি ও ভূরাজনীতির খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয়ও। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সায়েম সাবু

জাগো নিউজ : গত পর্বে ভৌগোলিক রাজনীতির কথা বলেছিলেন। সরকার তো ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থান নিয়ে রাজনীতি করতে চাইছে…

অধ্যাপক আবু আহমেদ : বাংলাদেশ যতদিন বড় কোনো অর্থনীতির অংশ হতে না পারবে, ততদিন ধনীরা মনে করবে বাংলাদেশ একটি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র। এখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকবেই। এখানে বিনিয়োগ করার কোনো সুযোগ নেই।

পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিম্ন পর্যায়ে। সার্ক সম্মেলন হলো না। এ অঞ্চলে মুক্তবাণিজ্য থাকলে সবাই বিনিয়োগের সুযোগ পেত। আসিয়ানের সঙ্গে মিয়ানমার যুক্ত হলো। আমরা পারলাম না।

ইন্ডিয়া-চীনের টানাপোড়েনে বাংলাদেশ জিম্মি হয়ে পড়ছে। আমাদের অবস্থানের কারণে সবার কাছ থেকে সুবিধা নেয়া উচিত। আমরা তা পারছি না। এ কারণে এখানে ধনীরা ধনী হবে এবং তারা অর্থ বাইরে পাচার করবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে কর্পোরেট ইনকাম ট্যাক্স অনেক বেশি। ইংল্যান্ড কমিয়ে ফেলছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে করতে চাইছে।

জাগো নিউজ : আপনার মত কি?

অধ্যাপক আবু আহমেদ : আমাদের পরামর্শ ছিল কর্পোরেট ইনকাম ট্যাক্স ২০ শতাংশে নিয়ে আসা। এতে শেয়ারবাজার আরও চাঙ্গা হতো।

জাগো নিউজ : তার  মানে বিনিয়োগের পরিবেশ দিন দিন আরও জটিল হচ্ছে?

অধ্যাপক আবু আহমেদ : সম্প্রতি চাইনিজ অ্যাম্বাসেডর তার এক বক্তব্যে বলেছেন, ‘একবার কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে আসলে তিনি আর দ্বিতীয়বার আসবেন না। বিমানবন্দর থেকেই ঘুরে যাবেন।’

এটি আমাদের বোঝা উচিত। কাগজে-কলমে আমাদের সবই ঠিক। কিন্তু প্রয়োগ করতে গেলেই সমস্যা। জমি মেলে না। মিললেও নিবন্ধন নিয়ে ঝামেলা। ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়মে বিনিয়োগকারীরা অতিষ্ঠ। বিদেশিরা আসবে কেন? এ কারণে অনেকে বিদেশি বিনিয়োগকারী ইন্ডিয়ায় বিনিয়োগ করে বাংলাদেশে মালামাল সাপ্লাই দিচ্ছে।
এটি বাংলাদেশের জন্য খারাপ বার্তা।

জাগো নিউজ : এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী কোনটি?

অধ্যাপক আবু আহমেদ : অবশ্যই রাজনীতি, আমাদের দেশের রাজনীতিই এজন্য প্রধান দায়ী। প্রধানমন্ত্রী একটি দলের হলেও তিনি সবার। এটি আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীরা ভুলে যান। বিভাজনের রাজনীতিই তাদের জন্য মুখ্য হয়ে ওঠে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে অনেক কথাই বলেছেন। ক্ষমতায় এসে সুর পাল্টিয়েছেন। এছাড়া তো উপায় নেই। বাংলাদেশে রাজনীতির কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতি এভাবে চলতে পারে না। সবার অংশগ্রহণ না থাকলে তো তাকে গণতন্ত্র বলা যায় না।

রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণ থাকলে সবাই বিনিয়োগ করতে আসবে। জনগণের মধ্যে বিভাজন তীব্র থাকলে কেউ বিনিয়োগ করতে সাহস পায় না। এমনকি দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও না। এ কারণে এক বছরে ৭৩ হাজার কোটি টাকা বাইরে পাচার হয়ে গেছে। অথচ এক হাজার কোটি টাকা ঋণ পেতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কতবার বৈঠক করছে সরকার।

জাগো নিউজ : উন্নয়নে অধিক জনসংখ্যাও তো দায়ী?

অধ্যাপক আবু আহমেদ : এটি একটি বাধা বটে। কিন্তু এখন তো অধিকাংশ মানুষই কর্মক্ষম। তাদের কাজের ব্যবস্থা করতে পারলে অর্থনীতি আরও সচল হতে পারত।

রাজনীতির কারণে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়নি। রাজনীতি সুষ্ঠু হলে সামাজিক নিরাপত্তা এমনিতেই বাড়ত। এমন অস্থিরতা থাকত না। সামাজিক অস্থিরতা থাকলে কে ঝুঁকি নেবে?

জাগো নিউজ : এমন অস্থিরতার মধ্যেও দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন হচ্ছে।

অধ্যাপক আবু আহমেদ : এ উন্নয়ন সাধারণের ভাগ্য পরিবর্তন করে না। ক’জন সাধারণ মানুষ ফ্লাইওভার দিয়ে পারাপার করে। সাধারণ মানুষ তলানিতেই থেকে যায়।
আবার অর্থ দিয়ে সেবা নিতে চাইলে, তা দিতেও পারছে না সরকার। ব্যবস্থাপনা ত্রুটির কারণেই এটি হচ্ছে না। রাস্তা করা হয়েছে, ফ্লাইওভার করা হয়েছে। সেখানে যদি যথাযথ উপায়ে টোল আদায় করে আরও রাস্তা বানানো যেত মানুষ খুশি হতো। হাতিরঝিলে একটি বক্স বসিয়ে টোল আদায়ের ব্যবস্থা করে রাষ্ট্র আয় করতে পারত।

সরকারের পলিসিগত দুর্বলতার কারণেই অস্থিরতা বাড়ছে। পলিসি নেই বলেই ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা গেলে স্বজনরা গিয়ে হাসপাতাল ভাঙচুর করছে। ভেজাল ডাক্তারে। ভেজাল রোগীর স্বজনদের মধ্যেও। অন্য দেশে আপনি এমন চিত্র দেখতে পাবেন না।

জাগো নিউজ : খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। বিষয়টি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?

অধ্যাপক আবু আহমেদ : রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ১৫ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। আমি পরিষ্কারভাবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করি। জনগণের টাকা এভাবে চুরির জন্য দেয়া ঠিক নয়। বেসরকারি ব্যাংকগুলো টাকা দিতে পারছে না। চুরি বন্ধ করুন। সব ঠিক হয়ে যাবে। ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন না আনলে হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়েও লোকসান ঠোকানো যাবে না।

জাগো নিউজ : কী সে পরিবর্তন?

অধ্যাপক আবু আহমেদ : একটি মাত্র শর্ত। সরকার বলবে, তোমাকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিলাম তিন বছরের জন্য। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়লে তোমার নিয়োগ বাতিল এবং খেলাপি ঋণের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এ শর্ত দিয়ে নিয়োগ দিলেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসবে।

সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ঋণ দিতে বেশ মজা পায়, কিন্তু ঋণ আদায় করতে তাদের চেষ্টা থাকে না।
এ কারণে জনগণের দেয়া ট্যাক্সের টাকায় বারবার খেলাপি ঋণের  জন্য পূরণ করতে হচ্ছে। রাষ্ট্র পারছে না, আবার বেসরকারি খাতেও দিচ্ছে না। জনতা ব্যাংক আংশিক বেসরকারীকরণের কথা ছিল। করল না। বেসিক ব্যাংক কেন সরকারের হাতে রইল?

শেয়ারবাজারের অবস্থাও করুণ। ২০০৯ সালের পর গ্রামীণফোনের বাইরে আর কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসেনি। মাফিয়া আর কতিপয় মরিচা ধরা প্রতিষ্ঠান নিয়ে কখনও শেয়ারবাজার চলতে পারে না।

জাগো নিউজ : উপায় কী?

অধ্যাপক আবু আহমেদ : ভালো কোম্পানিকে শেয়াবাজারে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। সুশাসনের ব্যবস্থা না থাকলে, জবাবদিহিতা না থাকলে কোনো উপায় থাকবে না।

জাগো নিউজ : ব্যাংক-শেয়ারবাজারের এমন দশায় মানুষের আস্থা তো তলানিতে?

অধ্যাপক আবু আহমেদ : সরকারি ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা কমছে। বেসরকারি ব্যাংকের ওপর আস্থা কমেনি। বেসরকারি ব্যাংকের সবচেয়ে খারাপটা সরকারি ব্যাংকের সবচেয়ে ভালোটার থেকেও ভালো।

জাগো নিউজ : বিকল্প কিছু কি নেই?

অধ্যাপক আবু আহমেদ : ব্যাংকের কোনো বিকল্প হয় না। মানুষ ব্যাংক ছেড়ে যাবে কোথায়?
রাজনৈতিকভাবে ব্যাংক দেয়া হচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে বীমা দেয়া হচ্ছে। আবার রাজনৈতিকভাবেই ঋণ দেয়া হচ্ছে। মানুষের বিশ্বাস কমে যাচ্ছে। ব্যাংকের মালিকরা শত শত কোটি টাকার মালিক। তাই দেখে রাজনীতিকরা হুমড়ি খেয়ে নিচ্ছে ব্যাংকের অনুমোদন। কিন্তু এখন ব্যবসা নেই। চেয়ারম্যান, এমডি হয়েই নিজেকে জাহির করছেন।

ব্যাংকের সর্বনাশের জন্য আরও একটি সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী বলে মনে করি। একই পরিবারের চারজন নয় বছর থাকতে পারবেন পরিচালনা পর্ষদে। এটি বিপজ্জনক বলে মনে করি। কোনো কারণে ব্যাংক কলাপস করলে তারা টাকা-পয়সা নিয়ে উধাও হওয়ার আশঙ্কা থাকে। হতেও পারে। এমন ইতিহাস বাংলাদেশে আছে।

ব্যাংক চলে জনগণের টাকায়। পরের ধনে পোদ্দারি করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এমনটি হলে আইনের আর কোনো বালাই থাকবে না।

বেসিক ব্যাংকের সর্বনাশ, সোনালী ব্যাংকের কেলেঙ্কারি সামনে থাকলেও তা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারিনি।

এএসএস/এমএআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।