সৌদিতে শ্রম বেচাকেনার ফাঁদে ওরা ৩১১ বাংলাদেশি


প্রকাশিত: ১২:৩৯ পিএম, ৩০ মে ২০১৭

কাজ না থাকায় বেকার অবস্থায় অত্যন্ত মানবেতর জীবন-যাপন করছেন সৌদি আরবের ‘আল নাদা’ কোম্পানির ৩১১ বাংলাদেশি কর্মী। খাবারসহ পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে গত বছরের জুলাই মাস থেকে এখন পর্যন্ত বহু কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তারা। 

অধিকাংশ শ্রমিকের বিরুদ্ধে নিয়োগকর্তা ‘পলায়ন’ বা ‘হুরুব’র অভিযোগ এবং ফাইনাল এক্সিট ফাইল ইস্যু করায় তারা অন্যত্র কাজের সুযোগ নিতে পারছেন না। তাদের মধ্যে মাত্র ৬০ জনকে অন্যত্র কাজের ব্যবস্থা করতে পেরেছে সৌদির বাংলাদেশ দূতাবাস।

অসহায় এসব কর্মীর জন্য জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেট এবং বাংলাদেশি কমিউনিটির সহায়তায় খাবার, বিদ্যুৎ ও বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রয়েছে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মিশন ও কল্যাণ) মোহাম্মদ আজহারুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সৌদি সফরকালে এসব কর্মীর আশ্রয় নেয়া ভিলাটি পরিদর্শ করেন এবং তাদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেন।

এ প্রসঙ্গে আজহারুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আল নাদা কোম্পানিতে কাজ ছিল না। এরপর স্থানীয় আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী নামে এক বাংলাদেশির মাধ্যমে কোম্পানিতে কয়েকশ বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। এসব কর্মী মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করে সৌদি যান। কিন্তু এখন সেখানে কোনো কাজ না থাকায় তারা অসহায় হয়ে পড়েন। তাদের নামে মামলা থাকায় অন্য কোম্পানিতেও কাজের সুযোগ নেই।’

আজহারুল হক বলেন, ‘মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে স্থানীয় কনস্যুলেটকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’

জানা যায়, আল নাদা কোম্পানি সৌদি আরবের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থায় শ্রমিক সরবরাহের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। জেদ্দা থেকেও ৮০০ কিলোমিটার দূরে দেশটির আসির প্রদেশের আবহা শহরে প্রতিষ্ঠানটির সদর দফতর। একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার প্রতিষ্ঠানটি গত ২০ বছর ধরে কার্যক্রম চালাচ্ছে। তাদের মোট জনশক্তির ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশি। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ২০০৮ সালে কোম্পানিটির জনশক্তি ১৫০০ থেকে ৭৯৩ জনে নেমে আসে।

Workers

দূতাবাস সূত্রে জানা যায়, কোম্পানি মালিকের অনৈতিক কার্যক্রম, শ্রমিক নির্যাতন ও অধিকার বঞ্চনার সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘনের কারণে সৌদির অন্যতম খারাপ কোম্পানিগুলোর অন্যতম হিসেবে এটি পরিচিতি পায়। সেখানে সাধারণ কর্মীদের বেতন ছিল মাত্র ৩০০ সৌদি রিয়াল। এত কম বেতন দেয়া হলেও খাবার কিনে খেতে হয় কর্মীদের নিজেদের।

এছাড়া কর্মীদের কাছ থেকে আকামা বাবদ বাৎসরিক ৮৫০ রিয়াল আদায় করা হতো। ছুটির টিকিট ও ছুটির ভাতাও তাদের ভাগ্যে জুটত না। পানি, বিদ্যুৎ সংযোগ ও কোম্পানির কোনো গাড়ি নষ্ট হলে তার মেরামত খরচও কর্মীদের দিতে বাধ্য করা হতো।

এমনকি হতভাগ্য কোনো কর্মীর মৃত্যু হলে তার মরদেহ দেশে পাঠাতে খরচ অন্যান্য কর্মী থেকে চাঁদা তুলে সংগ্রহ করা হতো।

সূত্র জানায়, আল নাদা কোম্পানিতে সাধারণত কর্মীদের ছুটি দেয়া হয় না। প্রাণান্তকর চেষ্টায় ৫-৬ বছর কাজ করেও প্রজেক্ট সুপারভাইজারকে উৎকোচ দিয়ে ছুটির ব্যবস্থা করতে হয়। এছাড়া কোনো কর্মীকে ছুটি থেকে ফেরত আসার নিশ্চয়তার জন্য তিনজন কর্মরত কর্মীকে লিখিতভাবে জামিনদার হতে বাধ্য করা হয়।

কর্মীদের আবাসন ব্যবস্থাও ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। ৩০০ জন কর্মীর জন্য একটি ভিলা, সেখানে টয়লেট রয়েছে মাত্র তিনটি।

Workers

এদিকে কর্মীদের অধিকার হরণ এবং সমস্যা জানার পর বাংলাদেশ কনস্যুলেট কোম্পানির দফতর ও শ্রমিকদের ভিলা পরিদর্শন করে অভিযোগের সত্যতা পায়। বিষয়টি কোম্পানির মালিককে মৌখিকভাবে জানিয়ে কর্মীদের শ্রম অধিকার ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ সম্বলিত একটি নোট ভারবাল সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

বিষয়টি জানতে পেরে আল নাদার মালিক বাংলাদেশ কনস্যুলেটের বিরুদ্ধে কোম্পানির শ্রমিক ভিলায় হামলার অভিযোগ তুলে সৌদি পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দাখিল করেন। ২০০৮ সালে কনস্যুলেটের পক্ষ থেকে নোট ভারবালের মাধ্যমে সেই অভিযোগের জবাব দেয়া হয়। সেটি আমলে নিয়ে সৌদি সরকার মেসার্স আল নাদা কোম্পানির সরকারি সব প্রজেক্ট স্থগিত করে। এছাড়া কোম্পানির অনুকূলে নতুন ভিসা ইস্যুও বন্ধ করা হয়।

সরকারি কোনো প্রজেক্ট না থাকায় জেদ্দার মেসার্স ইনিশিয়াল কোম্পানির বাংলাদেশি প্রজেক্ট সুপারভাইজার আবদুল কুদ্দুস চৌধুরীকে দায়িত্ব দিয়ে ৪৫০ কর্মীকে ইজারাভিত্তিক সরবরাহ করা হয়। ১২ ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে পদানুসারে কর্মীদের বেতন এক হাজার থেকে ১৫০০ সৌদি রিয়াল ধরা হয়।

এসব কর্মীর অভিযোগ, কুদ্দুস চৌধুরী নিয়োগকর্তার বরাত দিয়ে আকামা নবায়ন বাবদ ৮৫০ রিয়াল, পাসপোর্ট নবায়ন বাবদ ৩০০ রিয়াল, ছুটির টিকিট ও ভিসা বাবদ ৩ হাজার ২০০ রিয়াল এবং ফাইনাল এক্সিট বাবদ ২ হাজার ১০০ রিয়াল অন্যায়ভাবে কর্মীদের কাছ থেকে আদায় করতেন।

গত বছর জুলাই মাসে ইনিশিয়াল কোম্পানি নিজস্ব কর্মী আমদানির কারণে আল নাদা কোম্পানির ইজারাভিত্তিক কর্মীদের ছাঁটাই করা হয়। এরপর থেকে কনস্যুলেটের অদূরে নাজলা এলাকায় একটি ছোট্ট ভিলায় ৩৬৭ কর্মীকে থাকতে দেয়া হয়।

Workers

এসব কর্মীর কাজ, বেতন, খাবার, উপযুক্ত আবাসন, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবিতে গত বছরের ৫ আগস্ট জেদ্দার লেবার কোর্টে একটি মামলা করে বাংলাদেশ কনস্যুলেট। তবে ওইসব কর্মীর মধ্যে যারা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।

সৌদির বাংলাদেশ কনস্যুলেট সূত্র জানায়, বর্তমানে চারটি গ্রুপে ওই কোম্পানির মোট ৩১১ কর্মীর মামলা জেদ্দা লেবার কোর্টে প্রক্রিয়াধীন। ইতোমধ্যে পাঁচটি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতায় মামলার চূড়ান্ত শুনানি এখনও অনুষ্ঠিত হয়নি।

গত ৪ মে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে কাউন্সিলর মো. হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ভুক্তভোগী কর্মীদের বিষয়টি বিবেচনার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।

জেপি/এসআর/এমএআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।