রাজনৈতিক ঋণের কারণে খেলাপি বাড়ছে


প্রকাশিত: ১২:২৫ পিএম, ২৩ মে ২০১৭

ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। অধ্যাপনা করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিদেশে অর্থপাচার ও ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। তার মতে, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই বলেই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নতুন ভ্যাটনীতি এবং আসন্ন বাজেট প্রসঙ্গেও তিনি কথা বলেন। দুই পর্বের ধারাবাহিকের শেষ পর্ব আজ প্রকাশিত হলো-

জাগো নিউজ :  খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। গেল বছর এ বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় সাড়ে নয় হাজার কোটি টাকা। এটি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : এটি ভয়াবহ চিত্র। বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৩ হাজার কোটি টাকা, যা প্রদেয় ঋণের শতকরা ১০ দশমিক ৫৩ ভাগ। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। একই বছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গত তিন বছরের মধ্যে এ হার হচ্ছে সর্বোচ্চ।

জাগো নিউজ :  খেলাপি ঋণের হিসাব পুরনো। এজন্য কোন বিষয়ের ওপর দায় চাপাবেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : রাজনৈতিকভাবে প্রচুর ঋণ হচ্ছে বলেই খেলাপি বাড়ছে। বিশেষ যোগাযোগের মাধ্যমে ঋণ দেয়া হয়।
এক ব্যাংকের উদ্যোক্তা আরেক ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন কিন্তু সে ঋণ পরিশোধ করছেন না। আবার ওই ব্যাংকের উদ্যোক্তা আরেক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছেন না।

আবার যে আইনি ব্যবস্থা রয়েছে, তাও কার্যকর হচ্ছে না। লোন কোড করা হয়েছে। সেখানে অনেক মামলা জমা হয়েছে। আদালতের স্থগিতাদেশের সুরাহা হয় না সময় মতো। যে কারণে নৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এ সংকটের কারণে অনেকেই মনে করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করলে কোনো শাস্তি হবে না।

ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকেও যে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করার কথা, তা হয় না। হয় ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ সক্ষমতার অভাব আছে, নইলে ব্যাংকগুলো দুর্নীতির কারণে সক্ষমতা দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে।

জাগো নিউজ :  এ অবস্থায় ব্যাংকের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা নিয়ে কী বলবেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : সাধারণ মানুষের আস্থা তো কমছে। মানুষ টাকা দিয়ে স্বর্ণ কিনে বাড়িতে রাখবে, তা নিরাপদ না। শেয়ারবাজারে আস্থা নেই। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে চায় না। অনেকেই আবার শেয়ারবাজার থেকে চলে গেছে। মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যাংকে টাকা রাখে। কিন্তু সেখানেও ঝুঁকি বাড়ছে। আস্থা কমলে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার ক্ষমতা কমে যাবে।

জাগো নিউজ : ব্যাংকগুলো তাহলে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : হ্যাঁ। ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি বাড়ছে। খেলাপি ঋণ নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি ১০টি বড় ঋণগ্রহীতা খেলাপি হয় তাহলে ৩৭টি ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনা ব্যর্থ হবে। তখন বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেনও ব্যর্থ হবে।

জাগো নিউজ :  সঙ্কট উত্তরণের উপায় কী?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : প্রথমত, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সঙ্কট মোকাবেলায় দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয়া বন্ধ করতে হবে। বিশেষ যোগাযোগের মাধ্যমেও ঋণ দেয়া বন্ধ করতে হবে। সম্পর্কের ভিত্তিতে কারও প্রতি আনুগত্য দেখানোর সুযোগ থাকতে পারে না।

জাগো নিউজ :  ‘আনুগত্য’র প্রসঙ্গ আনলেন। কতটুকু ভরসা রাখা যায়?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : চলমান পরিস্থিতিতে ভরসা পাওয়া দুষ্কর। বলার জন্যই বলা আর কি!

জাগো নিউজ :  তাহলে উপায়?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান দরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের দরকার। অনেক মামলা ঝুলন্ত অবস্থায় আছে। মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ব্যবস্থা নেয়া দরকার। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ সক্ষমতাও বাড়ানো দরকার।

জাগো নিউজ : সামনে বাজেট অধিবেশন। প্রাক-বাজেট নিয়ে আলোচনা করছেন অনেকে। বাজেটের এ আয়োজন নিয়ে কী বলবেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী বাজেটের আকার ঘোষণা করেছেন। পাঁচ বছর ধরে বাজেট বাস্তবায়নের হার কমে যাচ্ছে। ২০১২ সালে বাস্তবায়নের হার ছিল ৯৩ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা নেমে আসে ৭৮ শতাংশে। এবার যে আকারের বাজেটের কথা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবায়ন হবে বলে মনে করি না। বাজেটে যতই সুফলের কথা বলা হোক না কেন, বাস্তবায়ন না হলে কোনো ফল আসে না।

জাগো নিউজ :  উচ্চাভিলাষী বাজেট হওয়ার কারণেই কি বাস্তবায়ন হচ্ছে না?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : আমাদের মতো দেশে বাজেট কিছুটা উচ্চাভিলাষী হবেই। তবে অলৌকিক কোনো চিন্তা নয়, বাস্তবায়নযোগ্য ধারণা থেকেই বাজেট মূল্যায়ন করা দরকার বলে আমি মনে করি।

জাগো নিউজ :  নতুন ভ্যাটনীতি নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : কর ব্যবস্থায় অনেকগুলো নীতি থাকবে। এ নীতিগুলো বাস্তবতার আলোকে হবে। রাজস্ব আয়ের মাধ্যমে কতটুকু অর্জন করতে পারবে সরকার, তার একটি নীতি থাকা দরকার। বাংলাদেশে রাজস্ব বাড়ানো দরকার। যেহেতু দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণের হার সর্বনিম্ন।

দ্বিতীয়ত হচ্ছে, ভোগ-বৈষম্যের দিক লক্ষ্য রাখা। তৃতীয়ত, কত সহজে কর আদায় করা যায় এবং সর্বশেষ হচ্ছে বিনিয়োগ ও সঞ্চয়ের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে; এসব বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে।

রাজস্ব বাড়াতে ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর বা মূসক) নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু সেটাই তো একমাত্র উপায় নয়। ভ্যাটের কারণে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে এবং এতে সমাজে আয়-বৈষম্য বাড়বে।

জাগো নিউজ : বৈষম্যের বিষয়টি যদি ব্যাখ্যা করতেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : ভ্যাটের চূড়ান্ত প্রভাব পড়ে ভোক্তার ওপর। অর্থাৎ যে পণ্য ভোগ করে তাকেই ভ্যাট দিতে হয়। একজন রিকশাচালক ১০০ টাকা আয় করলে তাকে ভোগের জন্য ১০০ টাকাই ব্যয় করতে হয়। অর্থাৎ তাকে ১৫ টাকা ভ্যাট দিতেই হবে। আবার কোনো সরকারি চাকরিজীবীর দৈনিক আয় ৫০০ টাকা। সে খরচ করল ১৫০ টাকা। বাকি ৩৫০ টাকা সঞ্চয় করল। সঞ্চয়কৃত আয়ের ওপর তাকে কোনো ভ্যাট দিতে হচ্ছে না। এ কারণেই বৈষম্য বাড়ে। আমার মনে হয় নতুন ভ্যাটনীতি বৈষম্য বাড়াবে।

জাগো নিউজ :  এ ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : রাজস্ব আয় বাড়াতে ভ্যাট দরকার। তবে ভ্যাটের হার কমানো দরকার।

দ্বিতীয়ত, জরুরি ভোগ্যপণ্য ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখতে হবে। চাল-আটার মতো পণ্যের ওপর ভ্যাট বসালে সমাজে বৈষম্য বাড়বে। যেসব পণ্য অপ্রয়োজনীয় তার ওপর ভ্যাট বাড়ানো যেতে পারে।

তৃতীয়ত, ভ্যাট সংগ্রহের সিস্টেমের পরিবর্তন আনতে হবে। একই সঙ্গে মনিটরিংও বাড়ানো দরকার।

এএসএস/এমএআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।