আসবাবে কাঠের স্থান দখল করছে প্লাস্টিক

মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘর সাজাতে কাঠের আসবাবপত্রের স্থান দখলে নিয়েছে প্লাস্টিকের রকমারি সামগ্রী। বই-খাতা, কাপড়, জুতা রাখতে প্লাস্টিকের র্যাক প্রায় অপরিহার্য। অতিথি আপ্যায়নে চেয়ার-টেবিল, টয়লেটের বালতি-মগের ব্যবহারও হচ্ছে দেদারছে।
খাবার ঢাকার সরপোশ থেকে শুরু করে ডাইনিং টেবিল, ওয়ারড্রপ, আলমিরাসহ গৃহ সাজানোর প্রায় সব ধরনের আসবাবপত্র এখন প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হচ্ছে।
একসময় প্লাস্টিক সামগ্রীর মধ্যে বালতি, বদনা, মগ ও চেয়ারই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হতো। আর গৃহের আসবাবপত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো কাঠের সামগ্রী। তবে এখন আর সেই চিত্র নেই। গৃহ সাজাতে কাঠের স্থান অনেকটা দখলে নিয়েছে প্লাস্টিক সামগ্রী। ফলে দেশের অভ্যন্তরে বেড়ে গেছে প্লাস্টিকপণ্যের ব্যবহার। একসময় যেখানে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল এক থেকে দেড় কেজি বর্তমানে তা বেড়ে পাঁচ থেকে ছয় কেজিতে দাঁড়িয়েছে।
তবে উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এখনও প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার অনেক পিঁছিয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তারা জানিয়েছেন, আমেরিকা, সিঙ্গাপুরের মতো দেশে মাথাপিছু প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার ১০০ কেজির ওপরে।
প্লাস্টিক খাতের ব্যবসায়ীদের মতে, প্লাস্টিকের আসবাবপত্র দেখতে সুন্দর, পরিবেশবান্ধব ও দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় ক্রেতারা কাঠের বদলে প্লাস্টিকের আসবাবপত্র ব্যবহার করছেন। আর প্লাস্টিকের আসবাবপত্রের ব্যবহার বাড়ায় কাঠের ওপর চাপ কমছে। এতে পরিবেশের উপকার হচ্ছে।
তারা বলছেন, গত এক দশকে দেশের প্লাস্টিকশিল্প বেশ বিকাশ লাভ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে অবকাঠামো ও নীতিগত সহায়তা পেলে বাংলাদেশের প্লাস্টিক খাত আরও এগিয়ে যাবে। এতে কাঠের ব্যবহার কমে যাওয়ায় একদিকে যেমন পরিবেশবান্ধব গাছ নিধন কমবে, তেমনি প্লাস্টিক সামগ্রী বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ প্লাস্টিকদ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি জসিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে। এ খাতের পরে প্লাস্টিকশিল্প হতে পারে অন্যতম একটি খাত। সরকার থেকে অবকাঠামোগত সহায়তা দিলে দেশের প্লাস্টিকশিল্প অনেক এগিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, সরকারের উচিত প্লাস্টিক শিল্পনগরী করে দেয়া। এছাড়া আমাদের যে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা পাওয়ার কথা সেটাও দেয়া হচ্ছে না। প্লাস্টিক ব্যবসায়ীরা সবাই যাতে সরকারঘোষিত ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা পান এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, প্লাস্টিক খাত থেকে সরকার বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকার ওপরে রাজস্ব পাচ্ছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্লাস্টিক সামগ্রী রফতানি করে আয় হচ্ছে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের মতো। গত এক দশকে দেশের ভেতরে মাথাপিছু প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বেড়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। তবে বহির্বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশে প্লাস্টিকের মাথাপিছু ব্যবহার এখনও অনেক কম। বর্তমানে এর ব্যবহার মাত্র পাঁচ-ছয় কেজি। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ১০০ কেজির ওপরে এবং সিঙ্গাপুরে ১২০ কেজির মতো।
এদিকে, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই ২০১৬ থেকে এপ্রিল ২০১৭ পর্যন্ত) প্লাস্টিকপণ্য রফতানি থেকে আয় হয়েছে ১০১ মিলিয়ন ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭৩ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়েছে ২৮ মিলিয়ন ডলার বা ৩৮ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওয়ারড্রফ, আলমিরা, দরজা, ডাইনিং টেবিল, বালতি, গ্লাস, জগ, র্যা ক, চেয়ার, টি-টেবিল, টিফিন বক্স, প্লেট, জার, বোল, ড্রাম, বদনা, পানির বোতলসহ গৃহের প্রয়োজনীয় প্রায় সকল পণ্যই পাওয়া যাচ্ছে প্লাস্টিকের তৈরি।
এসব পণ্য দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি দামেও সস্তা। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়াও সহজ। ফলে সহজেই সর্বসাধারণের আকর্ষণে পরিণত হয়েছে প্লাস্টিকের পণ্য। যে কারণে একসময় খেলনা সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার হওয়া প্লাস্টিক এখন গৃহসজ্জার অন্যতম প্রধান উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব প্লাস্টিকের পণ্য যেমন দেশিয় বিভিন্ন কোম্পানি তৈরি করছে, তেমনি ক্রেতাদের চাহিদার কারণে বিদেশ থেকেও আমদানি হচ্ছে।
দেশে আরএফএল’র তৈরি প্লাস্টিকের পণ্য ক্রেতাদের চাহিদার শীর্ষে আছে বলে জানিয়েছেন প্লাস্টিকপণ্য বিক্রেতারা। গৃহ সাজানোর প্রায় সব ধরনের আসবাবপত্র তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি। আরএফএল’র পাশাপাশি বেঙ্গল, তাজ, এনপলি, জেমিসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি প্লাস্টিক সামগ্রী পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। তবে গুণগত মান, ডিজাইন ও পণ্য বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে অন্যদের থেকে বেশ এগিয়ে রয়েছে আরএফএল। একই দোকানে বিভিন্ন কোম্পানির প্লাস্টিকের পণ্য বিক্রি করেন এমন কমপক্ষে ২০ ব্যবসায়ী ও ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ১০ বছর ধরে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবসা করছেন মো. রোমান। তিনি বলেন, একসময় প্লাস্টিকের পণ্য বলতে খেলনার সামগ্রী বোঝানো হতো। কিন্তু বর্তমানের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন প্লাস্টিক বলতে বোঝায় গৃহ সাজানোর আসবাবপত্র। মূলত ২০১২-১৩ সালের পর থেকে দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার হু হু করে বেড়েছে। দেখতে সুন্দর, দাম কম এবং বহন সহজ হওয়ায় প্লাস্টিকের পণ্যে মানুষের চাহিদাও অনেক বেড়েছে। আর এ চাহিদা বাড়ার ক্ষেত্রে আরএফএল’র পণ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
যাত্রাবাড়ীর ব্যবসায়ী মো. সেলিম জানান, কোম্পানি ভেদে প্লাস্টিকের র্যা ক পাওয়া যাবে ২০০ টাকা থেকে এক হাজার ৩০০ টাকায়। এছাড়া চেয়ার ৩৫০ টাকা থেকে এক হাজার ১০০ টাকা, টেবিল এক হাজার থেকে চার হাজার টাকা, টিফিন বক্স ৮০ থেকে ৩০০ টাকা, পানির বোতল ৫০ টাকা থেকে ৬৫০ টাকা, ড্রাম বালতি ৪৫০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
দামি সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে চার হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকার বিভিন্ন আলমিরা। একই ধরনের দামে পাওয়া যাচ্ছে ওয়ারড্রফ।
এমএএস/এমএআর/আরআইপি