প্রথমে পাঁচজন রক্ষী ছিল, এখন একাই : রেশমা
রেশমা বেগম। সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসলীলার জীবন্ত সাক্ষী। ভবন ধসের ১৭ দিন পর বিশাল ধ্বংসস্তূপ থেকে তাকে জীবিত উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। রেশমার উদ্ধারের ঘটনা ছিল মানব ইতিহাসের একটি বিস্ময়। সে সময় বিতর্কও উঠেছিল উদ্ধার অভিযান নিয়ে।
সুস্থ হওয়ার পর পাঁচ তারকা হোটেল ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ রেশমার চাকরির ব্যবস্থা করেন। মধ্যস্থতা করেন রানা প্লাজার উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া তৎকালীন সাভার ক্যান্টনমেন্টের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী।
এখন কেমন আছেন রেশমা? জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বর্তমান কর্মস্থল, রানা প্লাজার মৃত্যুকূপে ১৭ দিনের দুঃসহ স্মৃতির কথা প্রথম ব্যক্ত করেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : রানা প্লাজায় নিহত-আহতরা নানা সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন। আপনি কেমন পেলেন?
রেশমা : বেতন বাবদ আমাকে ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছিল। এরপর ২৫ হাজার টাকার একটি চেক দেয়া হয়। আরও একজন আমাকে ১০ হাজার টাকা দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী যখন আমাকে সিএমএইচে (ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল) দেখতে যান, তখন তিনি আমার আম্মার হাতে ৫০ হাজার টাকা তুলে দেন।
জাগো নিউজ : কারখানা মালিক বা বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে যোগাযোগ কিংবা কোনো সাহায্য করা হয়েছিল কিনা?
রেশমা : না। এখন পর্যন্ত তারা কেউ কোনো রকম যোগাযোগ করেনি।
জাগো নিউজ : এখন কেমন আছেন?
রেশমা : আছি, মোটামুটি ভালো আছি।
জাগো নিউজ : মোটামুটি কেন? ফাইভ স্টার (পাঁচ তারকা) হোটেলে ভালো বেতনে চাকরি করছেন। অনেক ভালো থাকার কথা…
রেশমা : ওয়েস্টিন হোটেলে আর আগের মতো নেই আমি।
জাগো নিউজ : ওয়েস্টিন হোটেলে কত টাকার বেতনে যোগ দিয়েছিলেন?
রেশমা : মূল বেতন ছিল পাঁচ হাজার টাকা। আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাবদ ৩০ হাজার টাকা।
জাগো নিউজ : বেতন তো খারাপ না?
রেশমা : আমার চাকরির ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। সবই জানেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী স্যার। তিনি আমাকে বলেছিলেন, সব মিলে প্রায় ৫০ হাজার টাকা বেতন দেয়া হবে।
জাগো নিউজি : এ চার বছরে মূল বেতন আর বাড়েনি?
রেশমা : না। বেসিক মূলত তিন হাজার টাকা। বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য ভাতা মিলে পাঁচ হাজার টাকা দেয়া হয়। এখন তিন হাজার থেকে পাঁচশ টাকাও কমানো হয়েছে।
এক টাকাও বাড়ানো হয়নি। বরং কোম্পানির ব্যবসা খারাপ হলে বেতন থেকে কাটা হয়। আমি কারো বিরুদ্ধে কখনো কোনো নালিশ করিনি।
জাগো নিউজ : যারা এখানে আপনার চাকরির ব্যবস্থা করলেন, তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়নি?
রেশমা : তারা সবই জানেন। খোঁজ নিয়ে জেনেছেন। আমাকে যে চাকরি দেয়ার কথা ছিল, তা দেয়া হয়নি।
জাগো নিউজ : আপনার কী কাজ করার কথা ছিল?
রেশমা : পাবলিক অ্যাম্বাসেডর হিসেবে অন্যদের কাজের তদারকির কথা ছিল। সেখান থেকে আমাকে আউটপুটে দেয়া হয়েছে।
জাগো নিউজ : সেখানে কী কাজ আপনার?
রেশমা : পরিষ্কার হয়ে আসা জামা-কাপড় গণনার কাজ। প্রথমে আমাকে একেবারে স্পেশাল করে ভাবা হতো। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলার সুযোগ দিত না। আমি তখন রীতিমতো ভিআইপি। প্রথমে পাঁচজন করে নিরাপত্তারক্ষী থাকত। এখন একাই।
প্রথমে আমার পরিবারের সদস্যদের হোটেলে প্রবেশের সুযোগ ছিল। কিন্তু প্রথমবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর আর কাউকে আমার কক্ষে ঢুকতে দেয়া হতো না। রাস্তায় দেখা করেই আত্মীয়-স্বজনদের চলে যেতে হতো।
জাগো নিউজ : আপনার রুম কোথায় ছিল?
রেশমা : হোটেলের মধ্যেই একটি রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা ছিল। পাশের রুমে অন্য মেয়েরা থাকত। থাইল্যান্ডের মেয়েরাও থাকত, যারা হোটেলে চাকরি করেন।
জাগো নিউজ : রুম ছাড়লেন কেন?
রেশমা : প্রথমে আমাকে বিনামূল্যে থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। পরে ভাড়ার কথা বলা হলো। একদিন এইচআর ম্যানেজার স্যার আমাকে ডেকে বললেন, ‘এমডি ম্যাডাম (নূর আলী স্যারের স্ত্রী) বলেছেন, রুমের ভাড়া বাবদ ১০ হাজার টাকা আমার সার্ভিস চার্জ থেকে কাটা হবে।’
তখন আমি বললাম, যদি বেতন থেকেই ভাড়া কাটা হয়, তাহলে আমি এখানে থাকব কেন? এখানে তো আমার মা-বোন-ভাই কেউই আসতে পারে না।
জাগো নিউজ : কবে রুম ছাড়লেন?
রেশমা : ২০১৪ সালের জুন মাসে রুম ছেড়ে দিয়ে গুলশানের পাশে নর্দায় বাসাভাড়া নেই। এখন মা-বোন ও ভাইয়েরা আসতে পারেন। সারওয়ার্দী স্যারের অনুমতি নিয়েই ওয়েস্টিনের রুম ছেড়ে দেই।
জাগো নিউজ : তার মানে আগের মতো আর গুরুত্ব পাচ্ছেন না?
রেশমা : না। আজ ২টার মধ্যে ছুটি নেয়ার কথা বলেছিলাম। সমস্যার কথাও বলেছিলাম। আমাকে আসতে দেয়া হলো না। আমার আজ (বুধবার, ৩ মে ২০১৭) ডে অফ ছিল। তাও বাতিল করা হয়েছে। পা কেটে গেছে। ব্যান্ডেজ করা। এরপরও ছুটি দেয়া হলো না।
একদিন নূর আলী স্যারের সঙ্গে লবিতে দেখা। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেলেন। খুব খারাপ লাগল। ভাবলাম, প্রথমে আমি কী ছিলাম, আর এখন কী হলাম!
জাগো নিউজ : আগে কথা হয়েছিল তার (নূর আলী) সঙ্গে?
রেশমা : অনেকবার তার সঙ্গে কথা হয়েছে। আজিম স্যারের মাধ্যমে তার অফিসে যেতাম। স্যারের বাসাতেও গিয়েছিলাম।
জাগো নিউজ : মৃত্যুকূপ থেকে বেঁচে আসা। জীবনের এ বেলায় কি বলবেন?
রেশমা : কষ্ট নিয়েই তো বেঁচে আসা। পৃথিবীর আলো দেখতে পারব, এটি ভাবতে পারিনি তখন। মেয়ে রেবার বয়স এখন ১৪ মাস। সারওয়ার্দী স্যার মেয়ের নাম রেখেছেন।
শ্বশুর বাড়ি বরিশালে। সবাই এখন ঢাকাতেই থাকেন। স্বামী রাব্বী একটি রিয়েল স্টেট কোম্পানিতে চাকরি করে। ও খুব ভালোবাসে আমাকে।
এএসএস/এমএআর/আরআইপি