রেল দুর্ঘটনায় আড়াই বছরে মৃত্যু ৮ শতাধিক


প্রকাশিত: ০৪:৪৪ এএম, ৩০ এপ্রিল ২০১৭

রেলের দুর্ঘটনা যেন বেড়েই চলছে। কোনোভাবেই অনাকাঙ্খিত মৃত্যু ঠেকাতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অরক্ষিত রেলক্রসিং, অপরিকল্পিত ও অননুমোদিত সংযোগ এবং সচেতনতার অভাবে গত আড়াই বছরে রেল দুর্ঘটনায় (নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-গাজীপুর) মারা গেছেন আট শতাধিক। আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন আরও ছয় শতাধিক।

শুধু রেলওয়ে পুলিশের হিসাব মতে, মৃত্যুর সংখ্যা ৭০০। খোদ রেল পুলিশ বলছে, সত্যিকার অর্থে রেল দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা আরও বেশি।

রেলওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ রেলওয়ে ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় জানায়, অপরিকল্পিতভাবে অনুমোদন ছাড়াই সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ সত্ত্বেও নাগরিকদের রেললাইনের ওপর দিয়ে বেপরোয়া চলাচল বন্ধ করা যাচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং, অপরিকল্পিত সংযোগ সড়ক এবং সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি রেলে দুর্ঘটনার পেছনে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর অব্যবস্থাপনাও দায়ী।

বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) কমলাপুর থানা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৯২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৪৮ ও নারী ৪৪ জন। অপমৃত্যু (ইউডি) মামলাসহ মোট মামলার সংখ্যা ২৮৫টি।

২০১৬ সাল রেল দুর্ঘটনায় মারা যান ৩০৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৪৪ ও নারী ৬১ জন। ইউডি মামলাসহ মোট মামলা ৩০৫টি।

সর্বশেষ চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছেন ১০৩ জন। এর মধ্যে শুধু জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৫, মার্চে ২৩ ও এপ্রিলে ২২ জন মারা যান।

crossing

এপ্রিলে শুধু গেন্ডারিয়া থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ঢাকা মহানগর এলাকায় রেল দুর্ঘটনায় মারা যান ১৮ জন। শুধু কমলাপুর থেকে কুড়িল ফ্লাইওভার পর্যন্ত অরক্ষিত রেলক্রসিং এবং উত্তরা এলাকায় মারা যান ১১ জন।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা রেলওয়ে থানার (কমলাপুর) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ট্রেন চলাচলের সময় রেলওয়ে আইন মানা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তা তোয়াক্কা না করে হেডফোন কানে দিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে চলাচল করায় মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। কাণ্ডজ্ঞানহীন ও অসাবধানতাই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। আবার অনেক স্থানে অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে কোনো নিরাপত্তাকর্মী নেই।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (অপারেশন) হাবিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ট্রেন যখন চলাচল করে তখন রেলওয়ের আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট লাইনের দুই পাশের ১০ ফুট এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। তাই ট্রেনে কাটা পড়ে নিহতের বিষয়টি আমরা মৃত্যু বলি। এর কোনো হিসাবও আমাদের কাছে থাকে না। রেলওয়ে পুলিশ যে তথ্য দিয়েছে তা ঠিক আছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনাবিদ আনোয়ারুল হক জাগো নিউজকে বলেন, রেলওয়ের লেভেল ক্রসিং উন্নয়নের জন্য এ মুহূর্তে দুটি প্রজেক্টের কাজ চলছে। ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে (পূর্ব) লেভেল ক্রসিং গেট আধুনিকায়ন’ ও ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে (পশ্চিম) লেভেল ক্রসিং গেট আধুনিকায়ন’ নামে দুই বছর মেয়াদের প্রজেক্ট দুটি চলবে আরও দেড় বছর। ১২শ’ উন্নতমানের রেলক্রসিং নির্মাণ করা হবে। এতে রেল দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে।

রেলওয়ের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিন কারণে রেল দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে লেভেল ক্রসিং দুর্ঘটনা, সিগন্যাল লাইনে ত্রুটি এবং উন্নয়ন কাজ চলা অবস্থায় ট্রেন লুপ লাইন কিংবা সাইড লাইনে চলে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়।

crossing

এছাড়া রেলওয়ের সিগন্যাল ও গার্ডসহ নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতদের অসতর্কতা কিংবা অবহেলার কারণেও রেল দুর্ঘটনা ঘটে। এ ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যাই বেশি। গত তিন বছরে দেশেজুড়ে লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে হাজারটি।

দেশে রেলওয়ের নেটওয়ার্কে ২ হাজার ৫৪১টি লেভেল ক্রসিং থাকলেও ২৪২টিতে রেলরক্ষী কর্মরত আছেন। বাকি দুই হাজার ২৯৯ স্থানে নিরাপত্তাকর্মী না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটছে।

এ বিষয়ে একজন এক্সপ্রেস ট্রেনের চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঢাকা থেকে ট্রেন ছাড়ার পরে গতি বাড়াতেই ভয় লাগে। না জানি কোথাও লেভেল ক্রসিংয়ের উপর গাড়ির সারি রয়েছে এ ভয়ে। সেই কারণে আসলে নির্ধারিত গতিতে ট্রেন চালানো যায় না।

গত তিন বছরে প্রায় এক হাজার রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১৭টি। বাকি অধিকাংশই লেভেল ক্রসিংজনিত দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬৪ টাকা।

গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সায়েদাবাদে লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন-বাস সংঘর্ষের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটি গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিংয়ে উড়াল সেতু নির্মাণের সুপারিশসহ কয়েকটি সুপারিশ পেশ করে। সুপারিশগুলো হচ্ছে- ক্রসিংগেটের আশপাশে অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলা, লোকবল বাড়ানো, গেইটম্যানের স্থায়ী পদ সৃষ্টি ও উড়াল সেতু নির্মিত হলে তার পাশে দেয়াল তুলে দেওয়া, ট্রাফিক সার্জেন্ট মোতায়েন, যতদিন গেটম্যান স্থায়ী না হয়, ততদিন গেটম্যানের পারিশ্রমিক বর্তমানের ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ১৬০ টাকা করা। এছাড়া তদন্তে লেভেল ক্রসিংয়ের উপর যানবাহন লাইন দিয়ে দাঁড়ানোর ফলে অনেক সময় গেটবার ফেলা সম্ভব না হওয়াকে দুর্ঘটনার আরও একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

গত এক বছরেও এসব সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি।

জেইউ/এমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

আরও পড়ুন