পণ্য ফেরত নিয়ে টাকা দিতে দারাজের ‘গড়িমসি’
দেশের অনলাইন শপিং সাইট দারাজের বিরুদ্ধে পণ্য ফেরত নিয়ে টাকা দিতে গড়িমসির অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া বিশ্বের শীর্ষ ই-রিটেইল ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম দারাজে প্রতিদিনই ঝামেলায় পড়ছেন গ্রাহকরা। অনেকেই অর্ডার করে সময় মতো পণ্য হাতে পাচ্ছেন না বা কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধিদের সহযোগিতা পাচ্ছেন না।
চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি মনসুর শোভন নামের এক ক্রেতা দারাজ থেকে ওয়ান প্লাস টু-এর ৮১০ টাকা (সর্বসাকুল্যে) মূল্যের একটি মোবাইল চার্জারের অর্ডার দেন। ৪ ফেব্রুয়ারি চার্জার হাতে পেয়ে দেখতে পান ক্যাবলটি ‘ডুপ্লিকেট ও দেশীয়’ এবং সেটি দিয়ে মোবাইলে চার্জ নিচ্ছে না।
দারাজের কল সেন্টারে বিষয়টি জানালে পরদিন ক্যাবলটি ফেরত নিয়ে যাওয়া হয় এবং সাতদিনের মধ্যে টাকা ফেরতের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। তবে প্রায় এক মাস পার হয়ে গেলেও টাকা ফেরত না পেয়ে দারাজের কাস্টমার কেয়ারে ফোন দেন শোভন। এ সময় সমাধান দিতে না পেরে আরও সময় চাওয়া হয় এবং প্রায় ছয় সপ্তাহ পর বিকাশের মাধ্যমে টাকা ফেরত দেয়া হয়।
মনসুর শোভন জাগো নিউজকে বলেন, ‘৮১০ টাকা ফেরতের জন্য দেড় মাসে দেড়শ টাকার কথা বলেছি কাস্টমার কেয়ারের সঙ্গে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে মামলা করার কথা ভেবেছিলাম। এ ধরনের ‘প্রতারণা’ কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
শোভনের এ ঘটনা ছাড়াও পণ্য ফেরতের টাকা নিয়ে গড়িমসি, ত্রুটিপূর্ণ ও ডুপ্লিকেট পণ্য বিক্রি এবং নিজেদের ইচ্ছামতো অর্ডার বাতিলের অভিযোগসহ নানা প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে দারাজের বিরুদ্ধে। কাস্টমার কেয়ারের কাছে আশানুরূপ সার্ভিস না পেয়ে কেউ কেউ ফেসবুকে বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগ করেছেন।
দারাজ সাধারণত পণ্য অর্ডার পাওয়ার পর তিন থেকে ১০ দিনের মধ্যে ডেলিভারি দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়। তবে ক্রেতাদের অভিযোগ, প্রায়ই অর্ডারের ১০-১২ দিন পর ‘স্টক না থাকায় অর্ডার বাতিলের’ তথ্য জানানো হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপায় দারাজ। প্রতিষ্ঠানটির পাবলিক রিলেশন ও কমিউনিকেশন বিভাগের ম্যানেজার সায়ন্তনী ত্বিষা জাগো নিউজকে বলেন, গ্রাহক (মনসুর শোভন) থেকে আমাদের কুরিয়ার সার্ভিস (তৃতীয় পক্ষ) ৫ বা ৬ ফেব্রুয়ারি পণ্যটি ফেরত নেয়। কিন্তু এটি আমাদের হাতে পৌঁছায় ১৩ মার্চ। আমরা দুদিনের মধ্যে (১৫ মার্চ) তাকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা ফেরত দেই।
তবে উজ্জ্বল কুমার সাহা নামে আরও এক ক্রেতা অভিযোগ করেন, দারাজে একটি পণ্য অর্ডার করে হাতে পেয়েছি আরেকটি। দারাজের কাস্টমার কেয়ার কিংবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। পরে ৯ ফেব্রুয়ারি পণ্যটি ফেরত দেই এবং ৫১ দিন পর (৩০ মার্চ) টাকা ফেরত পাই।
উজ্জ্বল কুমারের অভিযোগের বিষয়ে সায়ন্তনী ত্বিষা বলেন, তিনি (উজ্জ্বল কুমার) ৭ ফেব্রুয়ারি পণ্যটি ফেরত দিলেও আমরা তা হাতে পাই ১৬ ফেব্রুয়ারি। ২৩ ফেব্রুয়ারি তাকে টাকা পাঠাই। কিন্তু তিনি ৩০ মার্চ টাকা পান। ব্যাংকের কোনো ত্রুটির কারণে এ বিলম্ব হতে পারে।
দারাজের অন্যতম কুরিয়ার সার্ভিস সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘পাঠাও’। প্রতিষ্ঠানটির কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধি জানান, পাঠাও সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য ডেলিভারি করে। কাস্টমার পণ্য ফেরত দিলে দারাজে পণ্য পৌঁছে দিতে এতদিন লাগার কথা নয়।
দারাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে শামীম ফরহাদ নামে আরও এক ক্রেতা বলেন, গত ১৪ মার্চ এক জোড়া জুতা অর্ডার করি। কিন্তু তারা অন্য মডেলের জুতা পাঠায়। ফলে ২৪ মার্চ তা ফেরত দিলেও আর কোনো সাড়া পাইনি। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত টাকা ফেরতও দেয়নি।
দারাজকে ‘দায়িত্বহীন’ অনলাইন শপিং সাইট উল্লেখ করে ফাহাদ ইসলাম বলেন, গত ২২ মার্চ একটি পণ্য অর্ডার করি। ১২ দিন পর ৩ এপ্রিল দারাজ থেকে মেসেজ দিয়ে জানানো হয়, পণ্যটি তাদের স্টকে নেই। এটা জানানোর জন্য ১২ দিন কীভাবে লাগে? আমি জানি না তারা কীভাবে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে?
আবেদিন জইনুল নামে এক ক্রেতা অভিযোগ করেন, গত ১ মার্চ পণ্য অর্ডার করেছি কিন্তু ১৭ তারিখ পর্যন্ত কোনো ডেলিভারি পাইনি। আদৌ পাব কিনা জানি না। কল সেন্টারে ফোন দিলে লাইন কেটে যায়। অটো রিপ্লাই এসএমএস আসে, (অল আওয়ার কাস্টমার সার্ভিস এক্সিকিউটিভ আর বিজি। প্লিজ ওয়েট, উই উইল রিপ্লাই শর্টলি)।
সৌম্য রায়হান অভিযোগ করেন, তিনবার অর্ডার করার পরও পণ্য পাইনি। দারাজের কেউ সাড়া দেয়নি। ফেসবুকে তাদের ঠিকানা চেয়েছি, নিজে গিয়েই পণ্য সংগ্রহ করব বলে। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি।
রিজভী রেজওয়ান নামের এক ক্রেতা বলেন, ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে একটি গেইমিং মাউস অর্ডার দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত তিনবার রি-অর্ডার করেছি কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে দারাজের মুখপাত্র ত্বিষা বলেন, ‘দ্রুত বিকাশের কারণে আমাদের গুদাম বড় জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। ফলে কিছু অর্ডার জমা পড়ে এবং ডেলিভারিতে বিলম্ব হয়।’
তবে অর্ডার বাতিল হওয়ার বিষয়ে এক গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে দারাজের পেজে বলা হয়, ‘আমাদের নিজস্ব কোনো গুদাম নেই। আপনাদের অর্ডার পেয়ে নির্দিষ্ট কিছু ক্রেতার কাছ থেকে আমরা পণ্য সরবরাহ করে দেই। তাই ডেলিভারি ও শিপিং করতে বিলম্ব হয়।’
দারাজের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের এত অভিযোগের বিষয়ে ই-ক্যাবের (ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) প্রেসিডেন্ট রাজীব আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ই-ক্যাব অনলাইন ব্যবসায় জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে কাজ করে এবং দারাজ এর সদস্য। যদি দারাজের দ্বারা কোনো ক্রেতা হয়রানির শিকার হন তাহলে আমাদের কাছে অভিযোগ করতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে প্রথমে দারাজকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের (দারাজ) মেম্বারশিপ বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (এডি) আব্দুল জব্বার মণ্ডল বলেন, ভোক্তারা কোনো ব্যক্তি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে যদি প্রতারিত হন তাহলে অধিদফতরে অভিযোগ করতে পারেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এআর/আরএস/এমএআর/জেআইএম