নষ্ট ছোলায় লাভ বেশি


প্রকাশিত: ০৮:০২ এএম, ০৪ এপ্রিল ২০১৭

নষ্ট ছোলায় বেশি লাভ। বিষয়টি আশ্চর্যজনক হলেও এটিই বাস্তব। ভালো মানের ছোলা থেকে নষ্ট ছোলা কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এজন্য মজুদদাররা ৫০ কেজি ছোলার পেছনে খরচ করছেন ৩০ টাকা। মৌলভীবাজারের ডাল মিল শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

তারা জানিয়েছেন, মজুদের কারণে কোনো ডালের রঙ নষ্ট হয়ে গেলে তা মিলের মাধ্যমে রিফাইন করে খুব সহজেই চকচকে করা যায়।

ছোলার রঙ কালো হয়ে গেলে বা ছত্রাক লেগে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হলে তা মিলের সাহায্যে খোসা ছাড়িয়ে চকচকে করে বাজারে বিক্রি করা হয়। এর দাম রাখা হয় খোসাসহ ছোলা থেকে বেশি। তবে মানের দিক থেকে খোসা ছাড়ানো ছোলা সব থেকে নিম্নমানের।

বর্তমানে মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা খোসাসহ প্রতি কেজি ছোলা পাইকারি বিক্রি করছেন ৭৪-৭৫ টাকায়। আর খোসা ছাড়ানো ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ ৫০ কেজি নষ্ট ছোলার পেছনে ৩০ টাকা খরচ করলে ভালো মানের ছোলার মূল্য থেকেও ৭০০ টাকার বেশি পাওয়া যায়। ৫০ কেজির এক বস্তা ছোলার খোসা ছাড়িয়ে মিল শ্রমিকরা পান ১৩ টাকা। বাকি ১৭ টাকা খরচ হয় মিলে আনা-নেয়া বাবদ।

মৌলভীবাজারে ডাল মিলের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন পাঁচ ব্যবসায়ী। তারা হলেন- হাজি রাজ্জাক, টিটু হাজি, নেছার উদ্দিন খান, কাদের মিয়া ও সালাউদ্দিন। হাজি রাজ্জাকের মৌলভীবাজারে একটি এবং সাভারে তিনটি মিল আছে। বাকি চার ব্যবসায়ীর প্রত্যেকের চকবাজারে একটি করে মিল আছে।

মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশের ভেতরে যে ডাল উৎপাদন হয় তা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। যে পরিমাণ ছোলাসহ অন্যান্য ডাল খাওয়া হয় এর ৯০ শতাংশের বেশি আমদানি করা। এগুলো আমদানি করা হয় অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নেপাল, মিয়ামার, তুরস্ক ও ভারত থেকে।

আমদানি করা ছোলাসহ অন্যান্য ডাল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হয়ে প্রথমে যায় খাতুনগঞ্জ বাজারে। সেখান থেকে আসে মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে। তবে কিছু কিছু চালান সরাসরি ঢাকায়ও চলে আসে। পরে তা মৌলভীবাজারের ডালপট্টির ব্যবসায়ীদের হাত ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, চট্টগ্রাম বাদ দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারের ছোলাসহ অন্যান্য ডালের দাম বাড়া কিংবা কমা নির্ভর করে মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীদের ওপর। দাম নিয়ন্ত্রণে মৌলভীবাজারের আমদানিকারক ও মিল মালিকদের মধ্যে রয়েছে গভীর সম্পর্ক। মিল মালিক ও আমদানিকারকদের পারস্পরিক যোগসাজশে ডালের মজুদ হয়।

হাজি রাজ্জাকের মিলে কাজ করা এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে জানান, মজুদের কারণে ছোলার রঙ নষ্ট হয়ে গেলে বা অন্য কোনো কারণে ছোলা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা মিলের মাধ্যমে খোসা ছাড়িয়ে বাজারে বিক্রি করা হয়। ৫০ কেজির এক বস্তা ছোলার খোসা ছাড়াতে খরচ হয় ৩০ টাকা। এর মধ্যে মিল শ্রমিকরা পান ১৩ টাকা।

তিনি বলেন, ‘আমরা চারজন মিলটিতে কাজ করি। প্রতিদিন যা আয় হয় সবাই সমান ভাগে ভাগ করে নেই। কোনো দিন ৯০০ টাকা, আবার কোনো দিন হাজার বারশ টাকাও আয় হয়।’

হাজি রাজ্জাকের মিলে কাজ করা ওই শ্রমিক এবং নেছার উদ্দিন খানের মিলে কাজ করা আরও এক শ্রমিক জানান, মৌলভীবাজারে ছোলার খোসা ছাড়ানো এবং ডাল রিফাইন করতে পাঁচটি মিল আছে। মিলগুলোতে রঙ নষ্ট হয়ে যাওয়া ডাল চকচকে করা হয়। সাধারণ কোনো মানুষ এ ডাল দেখে বুঝতে পারবে না এগুলো পুরনো। মিলে রিফাইন করলেই নতুন ডালের মতো তা চকচকে হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, আগামী রমজান উপলক্ষে ইতোমধ্যে মজুদদাররা ছোলাসহ অধিক ব্যবহৃত ডাল মজুদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমদানির লক্ষ্যে এলসিও খোলা হয়েছে। এজন্য আগে থেকে মজুদ করা পণ্য ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই বাজারে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এ কারণে ছোলা, ডাবলি, খেসারির দাম কেজিতে প্রায় ৫ টাকা করে কমে গেছে।

বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ছোলাসহ বিভিন্ন ডাল মজুদ করে দাম বাড়ানোর যে অভিযোগ ওঠে তা সঠিক নয়। ব্যবসায়ীরা ছোলা বা ডাল মজুদ করেন না। কারণ মজুদ করে রাখলে ডালের রঙ নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি কোল্ড স্টোরের মধ্যে রেখেও মজুদ করা যায় না। কারণ কোল্ড স্টোর থেকে বের করার দু-একদিনের মধ্যে রঙ বিবর্ণ হয়ে যায়।

রোজার সময় দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিদেশের ব্যবসায়ীরাও চালাক। যখন তারা দেখেন আমরা অধিক মালের জন্য এলসি খুলছি, তখন তারা দাম বাড়িয়ে দেন। এতে আমাদের খরচ বেড়ে যায়। ফলে দেশের বাজারে দাম কিছুটা বাড়ে।

বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি নেছার উদ্দিন খান জগো নিউজকে বলেন, কিছু ব্যবসায়ী আছেন যারা ওজন বাড়ানোর জন্য ছোলায় পানি মেশান। পানি মেশানোর জন্য কিছুদিনের মধ্যে ছোলায় ফাঙ্গাস (ছত্রাক) লেগে যায়। এসব ছোলা সহজে সিদ্ধ হতে চায় না, আবার অনেক সময় তা খাওয়ার কারণে পেটে পীড়া হয়। যে কারণে এসব ছোলা খোসা ছাড়িয়ে বিক্রি করা হয়।

নিম্নমানের এসব ছোলা ভালো মানের থেকে কেন বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যবসায়ী এ নেতা বলেন, ‘এর পেছনে অনেক কারণ আছে। ছোলায় পানি দেয়া এবং ডালে ভেজাল দেয়ার বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম। কিন্তু হাজ সেলিম লোক দিয়ে আমাদের সেই আন্দোলন বন্ধ করে দিয়েছেন। আমরা বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলব, কেন ডালে ভেজাল দেয়া হচ্ছে?’

এমএএস/এমএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।