হাজারীবাগবাসীর স্বস্তির নিঃশ্বাস


প্রকাশিত: ০৯:৫৪ এএম, ০৩ এপ্রিল ২০১৭

হাজারীবাগ মানেই কারখানার ধোঁয়া, বাতাসে উৎকট গন্ধ, ড্রেনের পানিতে বিষাক্ত তরল বর্জ্য। ট্যানারি শিল্পের বর্জ্যের তীব্র দুর্গন্ধে এ এলাকায় টেকাই যেন দায়। কড়া দুর্গন্ধে শ্বাস নেয়া হয়ে পড়ে কষ্টকর।

দুর্গন্ধের ‘রাজ্য’ রাজধানীর হাজারীবাগের চামড়া শিল্পনগরীতে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে বসবাস করে আসছিলেন অত্র এলাকার মানুষ। অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তারা, হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারিশিল্প স্থানান্তরের খবরে।

শুধু হাজারীবাগের মানুষই নয়; জীবজন্তু, পশুপাখি, পানি, মাটি, বাতাস সবকিছুই যেন বিষে আক্রান্ত। হাজারীবাগে মোট ট্যানারির সংখ্যা কম-বেশি ২০০টি। এসব ট্যানারির কারণে বাতাস আর পানিতে ঘুরছে বর্জ্যের বিষ। এ বিষ হাজারীবাগ, লালবাগ, রায়েরবাজার, জিগাতলা, ধানমন্ডিসহ আশপাশের ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

hajaribag

পরিবেশ অধিদফতরের এক গবেষণায় দেখা যায়, হাজারীবাগ ট্যানারির তরল বর্জ্যের কারণে প্রতি বছর ৪০ কোটি ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। দুই হাজার ৪০৯ কোটি টাকার পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে। হিউম্যান হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান ওয়েলফেয়ার কস্ট অব এনভায়রনমেন্টাল পলিউশন ইন্ডাস্ট্রি ইন ঢাকা নামের একটি গবেষণা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। ওই গবেষণায় দেখা যায়, ওই সময়ে স্বাস্থ্যখাতে হাজারীবাগ এলাকার প্রতিটি মানুষের এক বছরে ১৫০ ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হয়। দূষণের কারণে এলাকার সম্পদ নষ্ট হয়। বাসা ভাড়া কমে যাওয়ার ফলে মোট ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়। বর্তমানে এ ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি।

রাজধানীর হাজারীবাগে থাকা সব ট্যানারি আগামী ৬ এপ্রিল থেকে বন্ধ হচ্ছে বলে জানিয়েছে মালিকপক্ষ। আদালতের নির্দেশনা মেনেই তারা ট্যানারি বন্ধের ঘোষণা দেন। গতকাল রোববার ধানমন্ডির একটি রেস্টুরেন্টে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তারা। একই সঙ্গে ৬ এপ্রিলের মধ্যে সাভারে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দেয়ার দাবি জানান ট্যানারি মালিকরা।

hajaribag

এর আগে ৬ মার্চ রাজধানীর হাজারীবাগের সব ট্যানারি অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত। একই সঙ্গে কারখানাগুলোর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি বিচ্ছিন্ন করাসহ সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬০ সাল থেকে গড়ে ওঠা রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারিশিল্প এলাকায় বাজছে বিদায়ের সুর। বর্তমানে ট্যানারি স্থানান্তরে প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত মালিকপক্ষ। আর এতেই স্বস্তি ফিরেছে এলাকাবাসীর মধ্যে।

ওই এলাকার গজমহল, কালুনগর, সোনা টাঙ্গর ও শিকারিটল ঘুরে এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্যানারির বর্জ্যের দুর্গন্ধে এখানে বসবাস করাই ছিল দায়। কিন্তু বাধ্য হয়ে এখানে তাদের বসবাস করতে হতো। ট্যানারি স্থানান্তরের সিদ্ধান্তে এখন এলাকাবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।

ট্যানারি বর্জ্যের কারণে যুগ যুগ ধরে এলাকা দূষিত হয়েছে। অথচ এজন্য দায়ী একশ্রেণির ব্যবসায়ী, তারা শুধু মুনাফার চিন্তা করেছেন। এখানের বাসিন্দাদের কথা তারা ভাবেননি। বাসিন্দারা শুধু শারীরিক নয়, নিয়মিত আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন- অভিযোগ করেন তারা।

hajaribag

অত্র এলাকায় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন রিয়াজুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, নিজের কর্মক্ষেত্রের জন্য এ এলাকায় বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। যুগ যুগ ধরে হাজারীবাগ-লালবাগের ট্যানারি এলাকায় সুষ্ঠু কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছিল না। ট্যানারি এলাকাজুড়ে বর্জ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণে এবং বর্জ্য পরিশোধনের কোনো প্ল্যান্টও ছিল না। যে যার মতো করে বর্জ্য ফেলেছে। ফলে এলাকার পরিবেশ দূষিত হয়েছে। মালিকপক্ষের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হতাম আমরা। এখন ট্যানারিগুলো স্থানান্তর হচ্ছে- এর চেয়ে বড় সুখবর আমাদের জন্য আর কী হতে পারে!

বাসিন্দা ফরিদা আক্তার বলেন, কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়ায় পুরো এলাকা আচ্ছন্ন হয়ে যেত। একটি স্টিলের আলমারি কেনার এক মাসের মধ্যে জং ধরে যায়। টিনের ঘরের চালগুলোও ধূসর বিবর্ণ হয়ে যায়। শুধু টিন নয়, পুরো হাজারীবাগ এলাকার মানুষ, মাটি, পানি ও বাতাস বিষে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ছোট শিশুরাও বিভিন্ন সময় নানা রোগে আক্রান্ত হয়। এসব কিছু বিবেচনা করে ট্যানারি স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত আমাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।

একটু ভিন্ন কথা বললেন দোকানি মাহাবুব রহমান। তিনি বলেন, এখানে ব্যবসা করছি ২০ বছর ধরে। বাসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ইলেক্ট্রিক পণ্য বিক্রি করি। ট্যানারিগুলো স্থানান্তরের খবরে আমার ব্যবসায়ও যেন বিদায়ের সুর বাজছে। বেচাবিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। কারখানা স্থানান্তরিত হলে আমার ব্যবসার কী হবে?

hajaribag

ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক বলেন, এখানে ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ২৫ হাজার শ্রমিক। এছাড়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর হলে এলাকাবাসী হয়তো স্বস্তি পাবে কিন্তু অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে- এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) রিভার কিপার শরীফ জামিল আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, যে দূষণ ঘটেছে, তাতে ট্যানারি সরিয়ে নেয়ার কয়েক যুগ পরও সেখানে দূষণ থাকবে। এরপরও স্থানীয়দের দাবি, যত দ্রুত সম্ভব ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তর করা হোক।

এএস/এমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।