হাজারীবাগে বাজছে ভাঙনের সুর


প্রকাশিত: ০৯:৩৯ এএম, ০৩ এপ্রিল ২০১৭

কারখানাগুলো থেকে আসছে না বড় বড় মেশিনের শব্দ। থমকে দাঁড়িয়েছে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের কার্যক্রম। কারখানাগুলো থেকে বড় আকারের মেশিনগুলো স্থানান্তরের কাজে ব্যস্ত শ্রমিক-মালিকরা।

কিছু কিছু কারখানায় ক্রেতাদের অর্ডার শেষ করতে চলছে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। এসব কারখানায় রাত জেগে কাজ করছেন শ্রমিকরা।

রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারি মেশিনসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্থানান্তরের কাজে ও শেষ সময়ে ব্যস্ততায় কাটানো শ্রমিকদের সবার মধ্যেই কিসের যেন বিষাদের ছায়া।

একটু গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকালেই উপলব্ধি করা যায় এসব শ্রমিকের চোখে-মুখে দীর্ঘদিনের চেনা কর্মপরিবেশ ছেড়ে যাওয়ার বেদনা।

কয়েকদিনের মধ্যেই বিদায় নিতে হচ্ছে হাজারীবাগ ট্যনারি এলাকা থেকে। ফলে হাজারীবাগের অলি-গলি আর বাতাসে এখন বাজছে ভাঙনের সুর।

আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী ৬ এপ্রিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হাজারীবাগের সব ট্যানারি। এর মধ্য দিয়েই ঢাকার এ অঞ্চলে প্রায় ৬৭ বছরের ট্যানারি শিল্পের ইতি ঘটতে চলেছে।

এদিকে সময় শেষ হয়ে আসায় এখন কর্মতৎপরতা অনেকাংশে কমে গেছে এখানে। আগে দৈনিক যে পরিমাণ চামড়া হাজারীবাগে আসত, এখন এর পরিমাণ অনেকটাই কম। শুধু যেসব প্রতিষ্ঠান সাভারের চামড়া নগরীতে স্থানান্তর করা হয়নি, সেগুলোতে চলছে স্থানান্তরের কাজ।

বন্ধ হয়ে যাওয়ার শেষ সময়ে এসে কিছু ট্যানারিতে শ্রমিকরা পার করছেন কর্মব্যস্ত সময়। আবার অনেকেই কাটাচ্ছেন কর্মহীন অবসর সময়। তাদের সবার মুখেই বিষন্নতার ছাপ। সামনে কী হবে, কীভাবে কাটবে তাদের দিন।

সম্প্রতি রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারি এলাকা সরেজমিনে ঘুরে এসব চিত্র দেখা যায়।

হাজারীবাগের কাউসার ট্যানারির শ্রমিক মনির হোসেন। ট্যানারি এলাকার এক মোড়ে বসেছিলেন। কথা বলতে গেলে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘মন-মেজাজ ভালা নাই। দেখছেন তো রাত ৯টায় রাস্তায় বইসা আছি। ট্যানারি বন্ধ কইরা পেটে লাথি মারার পাঁয়তারা করছে। ট্যানারি বন্ধ হইয়া গেছে। আমরা কী করমু, কী খামু।’

tanari

তিনি বলেন, ‘সাভারে ট্যানারি নিয়া যাবে। ওইখানে কই যামু, কই থাকুম। কাজ না থাকলে ভাত দিব কে। অন্য কাজ খুঁজতে হইব, না হয় বাড়ি চইলা যাইতে হইব।’

কথা হয় বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ট্যানারি বিষয়ে আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন। আদালতের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমরা (ট্যানারি মালিকরা) ৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার হাজারীবাগে থাকা সব ট্যানারি বন্ধ করে দেব। আমরা সরকারের কাছে সাভারের শিল্পনগরীতে গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগসহ বেশ কিছু দাবি জানিয়েছি। কারখানা স্থানান্তরের কাজ চলছে। আমাদের দাবি পূরণ হলে আশা করছি দ্রুত যেতে পারব।’

ফিনিশড লেদার পণ্য সরবরাহকারী রবিন এন্টারপ্রাইজের মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আগামী ৬ এপ্রিল গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেবে সরকার। তাই বড় ব্যবসায়ীরা রফতানি আদেশ ঠিক রাখতে দ্রুত কাজ শেষ করার তাগিদ দিচ্ছে। কাজের চাপে শ্রমিকরা দম ফেলার সময় পাচ্ছেন না। আগে যেখানে রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ হতো, এখন রাত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত কাজ হচ্ছে।’

বেঙ্গল লেদারের শ্রমিক ইব্রাহীম বলেন, ‘কাজ এখন কম হচ্ছে। কারখানা সাভারে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। কাজ কম, তাই ওভারটাইম হয় না। ইনকাম কমে গেছে। আগে পরিবার নিয়ে একসঙ্গে থাকতাম। কাজ কমে যাওয়ায় তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।’

ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক জানান, তিনি সরাসরি শ্রমিক হিসেবে ট্যানারিতে যুক্ত হন ১৯৬৪ সালে। তিনি বলেন, ‘৫৩ বছর ট্যানারির সঙ্গে জড়িত আছি। দীর্ঘদিন হাজারীবাগে থাকায় এ জায়গার প্রতি এক ধরনের আবেগ, মায়া জন্ম নিয়েছে। তবে দূষণ রোধে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর হচ্ছে। এটাকে আমরা স্বাগত জানাই।’

তিনি বলেন, ‘হাজারীবাগের ট্যানারির ওপর নির্ভর করে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের খাওয়া-পরা। এখন হাজারীবাগ থেকে আদালত ট্যানারি সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যেহেতু আদালতের নির্দেশ আছে, সেহেতু ট্যানারি সরিয়ে নিতেই হবে। তবে আমরা চাইব, হাজারীবাগের মত সেখানেও যেন আমাদের শ্রমিকরা কাজ পায়।’

হাজারীবাগের ট্যানারির কারণে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ ওঠে ১৯৮৬ সালে। ওই বছর সরকার ১৭৬টি ট্যানারিসহ ৯০৩টি কারখানাকে দূষণরোধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়।

পরবর্তীতে ২০০৩ সালে সাভারে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার প্রকল্প নেয় সরকার। এ প্রকল্পের আওতায় সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরা গ্রামে প্রায় ২০০ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় চামড়া শিল্পনগরী। সেখানে ১৫৪টি ট্যানারি সরিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু নানা অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করে আসছিলেন ট্যানারি মালিকরা।

এসবের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ মার্চ হাজারীবাগে থাকা ট্যানারির কার্যক্রম ৬ এপ্রিলের মধ্যে বন্ধ করা হলে জরিমানা মওকুফ করার বিষয়টি বিবেচনার কথা জানান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এ সময় আগামী ৯ এপ্রিল এ সংক্রান্ত পরবর্তী শুনানি গ্রহণের কথাও জানান আদালত।

এর আগে ২ মার্চ ১৫৪টি ট্যানারির বকেয়া বাবদ ৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা জরিমানা দুই সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

গত ১২ মার্চ হাজারীবাগে থাকা সব ট্যানারি কারখানা অবিলম্বে বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এর আগে ৬ মার্চ হাজারীবাগের সব ট্যানারি কারখানা অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

একই সঙ্গে কারখানাগুলোর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি বিচ্ছিন্ন করাসহ সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। ফলে গত তিন দশকের চেষ্টার পর অবশেষে হাজারীবাগ থেকে সরছে ট্যানারি।

এসআই/এসআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।