বইয়ের আশায় ঝর্না-রমজানরা
বস্তিতে লাগা আগুনে বই-খাতা-স্কুল ড্রেস পুড়ে যাওয়া সেই ঝর্না-রমজানের পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। স্কুল থেকে এখনও তাদের বই সরবরাহ করা হয়নি, ঠিকমতো তারা ক্লাসও করতে পারছে না। আগুনের ঘটনার ১৪ দিন পরও লেখাপড়ার বাইরে রয়েছে তারা।
১৬ মার্চ গভীর রাতে ভয়াবহ আগুনে রাজধানীর কড়াইল বস্তির অন্তত দেড় হাজার বসতঘর পুড়ে যায়। এসব ঘরে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাস করত অন্তত দুই হাজার শিক্ষার্থী। ঘরের আসবাবপত্র, খা্দ্যসামগ্রী, স্বর্ণালঙ্কারসহ পুড়ে ভস্মীভূত হয় প্রিয় বই ও স্কুল ড্রেস। বই পোড়ার সেই শোক এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ঝর্না-রমজানদের।
সেদিনের ভয়াবহ আগুনে সবকিছু পুড়ে যাওয়ার পর জাগো নিউজের কাছে তাদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বস্তির শিশুরা। তারা জানায়, শুধু শরীরের পোশাক ছাড়া কিছুই তারা রক্ষা করতে পারেনি। বই-খাতা-কলম সবই পুড়ে গেছে। কীভাবে স্কুলে যাবে? কে বই কিনে দেবে? দিলেও তো সঙ্গে সঙ্গে পাব না। বই পাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা কী পড়বে? তাদের স্বপ্নতো অনেক বড়…। পড়াশোনা করে মানুষ হবে, বাবা-মায়ের দুঃখ ঘোচাবে। কিন্তু সেটা কি আর সম্ভব হবে!
বস্তির শিশুদের সে আশঙ্কা দিন দিন আরও বাড়ছে। ১৪ দিন অতিবাহিত হলেও তারা কোনো বই পায়নি। স্কুল কর্তৃপক্ষ বই দেয়ার আশ্বাস দিলেও কবে নাগাদ দেয়া হবে সে বিষয়ে তারা কিছু্ই জানে না। বইয়ের আশায় এখনও প্রহর গুণতে হচ্ছে বস্তির শিশুদের।
বৃহস্পতিবার বই পুড়ে যাওয়া সেই ঝর্না আক্তারের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের। ঝর্না বলে, ‘ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। আগুন লাগার পর আর স্কুলে যেতে পারিনি। লেখাপড়ায় পিছিয়ে যাচ্ছি। স্যারেরা বই দিবে দিবে বলে। এখনও পাইনি। খাতা-কলম নেই যে কিছু লিখব। রাতে শোয়ার জয়গাও নেই।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে ঝর্না বলে, ‘আমার ছোট ভাই রমজান প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। তার রোল দুই। বাবা বলেছে তাকে ভালো করে পড়ালেখা শিখিয়ে মাস্টার বানাবে। কিন্তু বই-খাতা না থাকায় সে এখন আজেবাজে শিশুদের সঙ্গে সঙ্গ দিচ্ছে। দীর্ঘদিন লেখাপড়ার বাইরে থাকলে সে-তো আর মন বসাতে পারবে না। মা আমাদের নিয়ে চরম চিন্তায় আছে। এ মুহূর্তে তাদের কাছে অত টাকা-পয়সা নেই যে নিজ খরচে বই-খাতা কিনে দেবে। বাবা যে টাকা আয় করেন তা দিয়ে ঘরের পুড়ে যাওয়া আসবাবপত্র মেরামত আর খাবার জোগান দেয়াই কষ্টকর হচ্ছে।’
ঝর্না-রমজানের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হয়ে বস্তি থেকে একদিন সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বাবা-মায়ের কষ্ট লাঘব করবে। কিন্তু সব স্বপ্ন, সব আশা নিমিষেই পুড়ে গেল ওই রাতের ভয়াবহ আগুনে। এখনও বই না পেয়ে লেখাপড়া নিয়ে শঙ্কিত তারা। আদৌ স্কুল থেকে বই পাবে কিনা? পেলেও কবে পাবে? খাতা-কলম কে দেবে? এমন অনেক প্রশ্ন এখন তাদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
ঝর্না ও রমজানের বাবা জয়নাল আবেদিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আজ (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত তাদের বই দেয়া হয়নি। বস্তিতে অন্তত পাঁচ শতাধিক শিশু রয়েছে, যারা আশপাশের বিভিন্ন স্কুলে যায়, লেখাপড়া করে। তারা কেউ বই পায়নি। পড়ালেখা করতে না পারায় তারা এখন বস্তির বখাটে ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করছে। খুব ভয় হচ্ছে, পড়ালেখা থেকে আমার দুই সন্তান যেন বিমুখ হয়ে না পড়ে!’
তিনি বলেন, ‘স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা বলেছে ১ এপ্রিল বই দেবে। এর আগেও কয়েকবার বই দেয়া হবে বলে শিক্ষকরা জানিয়েছিলেন। কিন্তু স্কুলে বই আসেনি বলে আর দেয়া হয়নি। এভাবে আর কত দিন চলবে, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাতে ঘুম আসে না!’
জয়নাল আবেদিন স্থানীয় একটি কারখানায় শ্রমিক সর্দার হিসেবে কাজ করেন। ঝর্না ও রমজানের মা লেবুজা বেগম বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। বাবা-মায়ের অল্প আয় দিয়েই তাদের দিন চলে। বাবার আয় দিয়ে সংসারের খরচ আর মা কাজ করে যে টাকা পান তা দিয়ে দুই সন্তানের পড়াশোনার খরচ চলে।
একই বস্তির জান্নাতুল ফেরদাউস পড়ে মহাখালী মডেল হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে। তার রোল দুই। আগুনে তারও সব বই পুড়ে গেছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বই পায়নি। স্কুল ড্রেসও কিনতে পারেনি। সব হারিয়ে পোড়া ঘরের দরজায় বসে মুখভার করে বসেছিল সে। জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় তার।
জান্নাতুল ফেরদাউস বলে, ‘বই পুড়ে যাওয়ার পর স্কুলের স্যারকে বলেছি। আমাদের জন্য বিনা পয়সায় বইয়ের ব্যবস্থা থাকলেও এখন নাকি বই নেই। ক্লাসে গেলে বোকার মতো বসে থাকি। খাতায় যা লিখে আনি তাই পড়ি। এ কয়দিনে অনেক পিছিয়ে গেছি। রাতে ঘুমাতে পারি না। বাড়িওয়ালা এখনও বাসা ঠিক করে দেয়নি। ওই রাতে (আগুনের দিন) বৃষ্টি হয়েছিল। সারারাত ভিজেছি। এরপর থেকে অসুস্থ।’
সে আরও বলে, ‘আগুনে সব হারিয়েছি কিন্তু এতো কষ্ট পেতাম না। বহু মেধা খাটিয়ে একটি হ্যান্ডনোট তৈরি করেছিলাম। সেটি পুড়ে যাওয়ায় খুব কষ্ট হচ্ছে। খাতাটি রক্ষা করতে পারলে এখন পড়তে পারতাম। কবে স্যাররা বই দেবে জানি না! অপেক্ষায় আছি। বই দিলে আবার পুরোদমে লেখাপড়া শুরু করব।’
ঝর্না, রমজান, জান্নাতুল ছাড়াও এ বস্তির অন্তত পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর বই পুড়ে গেছে ওইদিন। বই হারিয়ে তারা এখন পড়ালেখা করতে পারছে না। কেউ কেউ বস্তির বখাটেদের সঙ্গে মিশে স্কুলবিমুখ হয়ে পড়ছে। জীবন গড়ার স্বার্থে দ্রুত বই সরবরাহের দাবি জানায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা।
এমএসএস/এমএআর/বিএ