সায়মন ড্রিং’র চোখে ‘গণহত্যা’
সাইমন ড্রিং একজন আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত বিদেশি সাংবাদিক, টেলিভিশন উপস্থাপক ও প্রতিবেদন নির্মাতা। তিনি বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের বৈদেশিক প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের অনেক জায়গা ভ্রমণ করেন এবং তরতাজা ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পরিবেশনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। এছাড়া তিনি লন্ডনভিত্তিক দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, বিবিসি টেলিভিশনে কাজ করেছেন।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর জঘন্য ও নৃশংসতার বিবরণ তুলে ধরে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার প্রতিবেদন সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতন ও গণহত্যার কথা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে সাইমন ড্রিং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (পরবর্তীতে হোটেল শেরাটন, বর্তমানে হোটেল রূপসী বাংলা) লুকিয়ে ছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তানে সামরিক আইনের তোয়াক্কা না করে ২৭ মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতিবেদন আকারে প্রেরণ করেন যা ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে ৩০ মার্চ প্রকাশিত হয়।
ওই প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন-
‘আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর।’ একাত্তরের এই পরম বন্ধুর সাক্ষাৎকার বিভিন্ন সময় পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। সেখানে তিনি বলেন-
আমি ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ প্রথমবারের মতো সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালনে পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসি। কম্বোডিয়া থেকে সরাসরি ঢাকায় আসতে হয়। কারণ, সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক হিসেবে তখন দায়িত্ব পালন করছিলাম। আর এখানে তখন গৃহযুদ্ধের মতো অবস্থা বিরাজ করছিল।
আমি ঢাকায় আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনতে পাই। তখন সেই ভাষণের সময় মঞ্চেরই এক পাশে অবস্থান করছিলাম। ভাষণের সময় সেখানে এক অসাধারণ পরিস্থিতি ছিল। আমি বাংলা কিছু বুঝতাম না। কিন্তু আমি শুনলাম শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ এবং উপলব্ধি করলাম ও দেখলাম জনতার অনুভূতি। পুরো বিষয়টি আমাকেও শিহরিত করল। আমি সবই বুঝলাম। তিনি মানুষের মনের কথা বলছেন, মুক্তির কথা বলছেন, স্বাধীনতার কথা বলছেন।
আমাদের পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, সব রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঢাকার অভিজ্ঞতায় তখন নিশ্চিত ছিলাম এখানে কোনো ধরনের সমঝোতার পথ নেই, একমাত্র পথ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা। এভাবেই ঢাকায় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে ২৫ মার্চ এসে গেল। বিকালে আমরা জানলাম আলোচনার জন্য ঢাকায় আসা ইয়াহিয়া খান কোনো সমঝোতা ছাড়াই ঢাকা ত্যাগ করেন। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ভীতিকর হতে লাগল। শহরজুড়েই নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ল। আমরা বুঝতে পারলাম এখানে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমরা প্রায় এক থেকে দেড়শ বিদেশি সাংবাদিক ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থান করছিলাম। একসময় আমাদের হোটেলে কিছু সেনা সদস্য চলে এলো। অবস্থা এমন হলো যে, পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সব বিদেশি সাংবাদিককে অস্ত্রের মুখে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবরুদ্ধ করে রাখা হলো।
রাস্তায় পাকিস্তান আর্মির গাড়ি মুহুর্মুহু টহল দেওয়া শুরু করল। কিছু তরুণ অবশ্য এয়ারপোর্ট রোডে ব্যারিকেড দেওয়ারও চেষ্টা করছিল। তখন আমরা হোটেলের বাইরে বের হওয়ার অনুমতি পাচ্ছিলাম না। এমনকি বের হওয়ার সব দরজাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তখন সব সাংবাদিক চেষ্টা করছিলাম জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার। ফটোসাংবাদিকরা জানালা দিয়েই ছবি তোলার চেষ্টা করছিল। এদিনই মধ্য রাতে গোলাগুলি শুরু হলো। রাত ১০টার কিছুক্ষণ আগে আর্মিরা শহরের রাস্তা দিয়ে চলাচল শুরু করে। রাত ১১টার দিকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। তখন যারা বিভিন্ন বেসামরিক গাড়ি উল্টিয়ে, গাছের গুঁড়ি ফেলে বা কংক্রিটের পাইপ ফেলে ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তারাই সেনাবাহিনীর প্রথম শিকারে পরিণত হয়। মধ্যরাতের কিছুক্ষণ পরই এম-২৪ ট্যাংক নিয়ে একদল সৈন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যায়।
সৈন্যরা ব্রিটিশ-কাউন্সিল-লাইব্রেরি দখল করে। সেখান থেকে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে গোলাবর্ষণের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। মর্টার ফায়ার ও কামান ফায়ারে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা প্রকম্পিত হতে থাকে। আমরা তখন হোটেলেই অবরুদ্ধ ছিলাম। বাইরে বের হতে পারছিলাম না। তবে বুঝতে পারছিলাম বাইরে কী হচ্ছে। বুঝলাম মানুষ মারা পড়ছে এবং পরিষ্কার ছিল যে, এটা এক পক্ষের যুদ্ধ ছিল। কারণ পাকিস্তান আর্মির গুলিবর্ষণের বিপরীতে কোনো গুলির শব্দ আমরা পাইনি। পাকিস্তান আর্মি গুলির মাধ্যমে যেন সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছে, এটা পাকিস্তান। এখানে অন্য কোনো সত্ত্বার অস্তিত্ব নেই।
সে দিনই আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করি। মুজিব আমাদের বলেছিলেন, তিনি আত্মগোপন করবেন না। কারণ তেমন কোনো কিছু হলে জনগণের ওপর অত্যাচার নেমে আসতে পারে। আমরা যখন শেষবারের মতো শেখ মুজিবের সঙ্গে যোগাযোগ করি তখন মধ্যরাত। তিনি আমাকে বলেন, তার বাড়ি থেকে তিনি সবাইকে বিদায় করে দিয়েছেন। রেখেছেন শুধু তিনজন গৃহকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মী। যেন তিনি প্রস্তুত হয়ে পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পরে তার এক প্রতিবেশীর কাছে শুনেছি রাত ১:১০টায় একটি ট্যাংক, একটি অস্ত্রসজ্জিত কার ও এক ট্রাকভর্তি সৈনিক বাড়িটির দিকে এগিয়ে আসে ফাঁকা গুলি করতে করতে। সৈন্যবহর বাড়িটির বাইরে এসে থামলে একজন অফিসার ইংরেজিতে ডাক দিল, শেখ সাহেব, আপনি বেরিয়ে আসুন।
এ আহ্বানের জবাবে তিনি ব্যালকনিতে বেরিয়ে এলেন এবং বললেন, হ্যাঁ। আমি প্রস্তুত। কিন্তু গুলিবর্ষণের কোনো প্রয়োজন নাই। টেলিফোনে আহ্বান করাই যথেষ্ট ছিল। আমি নিজে গিয়ে হাজির হতাম। এরপর অফিসারটি বাড়ির বাগানের মধ্যে হেঁটে গিয়ে বললেন, আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। দেহরক্ষীকে বেদম প্রহার করা হলে তিনি অফিসারটিকে গালি দিতে শুরু করলেন। পার্শ্ববর্তী বাড়ির নৈশপ্রহরী প্রাচীরের আড়ালে লুকাতে গেলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরের দিন বেলা ২টার দিকে আবারও প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ হয়। তখন রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের ৫-৬টা স্থানে গুলি হতে থাকে। পরে সন্ধ্যা ৬টায় আবারও গুলি হতে থাকে। আমরা হোটেল থেকে শুধু মানুষের আর্তনাদ শুনতে থাকি। তখন আমাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো যোগাযোগ ছিল না। তাই সাংবাদিকদেরও কিছুই করার ছিল না।
আমরা নানাভাবে সময় কাটাচ্ছিলাম। তখন পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগের মেজর সালেক সিদ্দিকী আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলো। এসে আমাদের লাগেজ বেঁধে তৈরি হতে বললো। যে কোনো মুহূর্তে আমাদের নিরাপত্তার জন্যই দেশত্যাগ করতে হবে বলেও জানান মেজর। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি দেশত্যাগের নির্দেশ? উত্তরে মেজর আমাকে বলল, না, এটা তোমাদের নিরাপত্তার জন্য উপদেশ। কারণ এখানে কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোলা ছুড়ছে, তাদের মোকাবিলার জন্য পাকিস্তান আর্মিকেও গুলিবর্ষণ করতে হচ্ছে। তোমরা বিদেশিরা ক্রসফায়ারে পড়ে যেতে পার। এটা তোমাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।
আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আমরা যদি ঢাকা ত্যাগ না করি? উত্তরে মেজর আমাকে জানান, এটা বিপজ্জনক হতে পারে। তখন আমি তাদের দেখানোর জন্য ব্যাগ-লাগেজ গুছিয়ে ফেলি। ভেতরের মানসিক সিদ্ধান্ত ঢাকা ত্যাগ করব না। আমি হোটেলের বাঙালি কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলি এবং লুকিয়ে থাকার জায়গা খুঁজতে থাকি। লাগেজ গুছিয়ে রেখেছিলাম যদি কোনো কারণে তাদের সামনে পড়ে যাই তা হলে বলব, ওহ, আমি ভুল করেছি। যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। লাগেজ গুছিয়েছি। তখন সব সাংবাদিককে চেক করে করে বিমানবন্দরে নেওয়া হচ্ছিল। ঠিক করি, আগামী ২ ঘণ্টা প্লেন ছাড়া পর্যন্ত এসির উপরে ছাদের নিচে লুকিয়ে থাকব। সেখানেই থাকলাম ২ ঘণ্টা। তারপর আরও ১ ঘণ্টা সেখানে থাকলাম। ভাবলাম যদি প্লেন ছাড়ার আগে আগে কারও নজরে পড়ে যে টেলিগ্রাফের ওই রিপোর্টার কই। তারা যদি হোটেলে খুঁজতে আসে। সে কারণে আরও বাড়তি ১ ঘণ্টা থাকলাম। পরে রাত সাড়ে ১০টায় আস্তে আস্তে নেমে এলাম ছাদ থেকে। আর্মি অফিসারদের এড়িয়ে হোটেলে মূল রিসিপশনে চলে এলাম। সেখানে বাঙালি কর্মচারীরা আমাকে দেখে বেশ আতঙ্কিত হলো। উদ্বেগ নিয়ে তারা সেনাদের কথা আমাকে জানাল। তাদের বোঝাতে সমর্থ হলাম, আমি কার্ফু শেষ হলে এখানকার খবর ও ছবি সংগ্রহ করতে চাই।
বিদেশে জানাতে চাই কী হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে। তখন তারা আশ্বস্ত হয়ে নিজেদের দায়িত্বে আমাকে সাহায্য করতে শুরু করল। তারাই আমাকে জানাল, হোটেলে আরও এক বিদেশি ফটোসাংবাদিক লুকিয়ে আছে, সেও ছবি তুলতে চায়। সে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) ফটোগ্রাফার মিশেল লরেন্ট। অত্যন্ত দক্ষ ফটোসাংবাদিক ছিল লরেন্ট। সে ভিয়েতনাম যুদ্ধের ছবি তুলতে গিয়ে সর্বশেষ সাংবাদিক হিসেবে মৃত্যুবরণ করে।
পরের দিন সকালে কার্ফু উঠে গেলে হোটেলের বাঙালিরাই আমাকে সাহায্য করল। তারা আমাকে বাইরে কিভাবে যেতে পারি সে ব্যবস্থা করে দিল। পরামর্শ দিল ছোট গাড়ি ব্যবহারের এবং কাপড়ে মুখ ঢেকে নেওয়ার। না হলে আমাকে দেখেই বুঝতে পারবে বিদেশি। সকাল ৭টার ৫-৬ মিনিট পর মিশেলকে নিয়ে অত্যন্ত সাধারণ কাপড়ে বের হলাম। আমরা প্রথমেই গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। এটাই ছিল আর্মিদের প্রথম টার্গেট। আশপাশের মানুষের সঙ্গে কথা বলি। জানলাম ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে কিভাবে কামান চালানো হয়েছে। আমরা দেখলাম দুই দিন পরও পুড়িয়ে দেওয়া কক্ষগুলোতে ছাত্রদের মৃতদেহ একটু একটু করে পুড়ছিল। অনেক মৃতদেহ বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, অবশ্য হলের পার্শ্ববর্তী পুকুরেই বেশিরভাগ মৃতদেহ ভেসে ছিল। চারুকলার একজন ছাত্রের মৃতদেহ পড়ে ছিল তার ইজেলের পাশেই হাত-পা ছড়িয়ে। সাতজন শিক্ষক নিহত হন। বাইরের ঘরে লুকিয়ে থাকা ১২ সদস্যের এক পরিবারের সবাইকেই হত্যা করা হয়েছে। সৈনিকরা অনেক মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। ইকবাল হলে এখনও ৩০টি মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। এ হলের করিডোরে যে-পরিমাণ রক্ত জমাট বেঁধে আছে তা নিশ্চিতভাবে এই ৩০ জনের চেয়ে অনেক বেশি মৃতদেহের রক্ত। অন্য একটি হলে মৃতদেহগুলো দ্রুত গণকবর খুঁড়ে পুঁতে রেখে এর উপর ট্যাংক চালিয়ে মাটি সমান করে দেওয়া হয়েছে। আশপাশে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশের রেললাইনের ২০০ গজ জুড়ে গড়ে ওঠা কুঁড়েঘরগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। টহলদার সেনাবাহিনী এখানকার একটা বাজার ধ্বংস করেছে এবং এর ঘুমন্ত দোকানদারদেরও হত্যা করেছে। দুই দিন পর যখন রাস্তায় বেরিয়ে এসব দেখার সুযোগ ঘটল, তখনো অনেক মানুষের মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে, তাদের পরনের কাপড় গলার কাছে উঠে এসেছে।
দেখলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজে বাজুকা হামলার চিহ্ন। মসজিদটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত। এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দিকে যাওয়া শুরু করলাম। যাওয়ার সময় দেখলাম সব বাড়িতে পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। রাস্তায় রাস্তায় অনেক লাশ। আর মানুষ ঘুরে ঘুরে এগুলো দেখছে। তখনো পাকিস্তান আর্মির অনেক গাড়ি টহল দিচ্ছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গিয়ে দেখলাম একস্থানে অভিযান শেষ করে সেনারা যতগুলো পারা যায় মৃতদেহ ট্রাকে করে নিয়ে গেছে। তারপরও পুরো এলাকায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ও যত্রতত্র লাশ পড়ে আছে। পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজনও জানে না ঠিক কতজন পুলিশ নিহত হয়েছে। ১১০০ পুলিশের মধ্যে খুব কমসংখ্যকই হত্যা এড়াতে পেরেছে বলে মনে হয়।
পরে গেলাম পুরান ঢাকার হিন্দু এলাকায়। সেখানে শুনেছি, সৈন্যরা অধিবাসীদের প্রথমে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াতে বলে। তারপর তাদের দলবদ্ধভাবে গুলি করে হত্যা করে। বাড়িগুলোও এরপর ধ্বংস করা হয়। সৈন্যরা বাঙালি ইনফর্মারদের সঙ্গে নিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড চালাতে শুক্রবার প্রায় রাত ১১টা পর্যন্ত পুরান ঢাকায় অবস্থান করে। সৈন্যরা সংকেত দিলেই বাঙালি ইনফর্মাররা আওয়ামী লীগের গোঁড়া সমর্থকদের বাড়ি চিনিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটি ধ্বংস করা হয় ট্যাংক চালিয়ে, রিকয়েলস্ রাইফেলের গুলিতে কিংবা এক ক্যান পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে।
নয়াবাজার এলাকার একজন অধিবাসী জানালেন, হঠাৎ করেই রাস্তার মাথায় সৈন্যদের গাড়ি দেখা গেল। অতঃপর প্রতিটি বাড়ি তাক করে গুলি করতে করতে তারা এগিয়ে এলো। অগ্রবর্তী বাহিনীর পেছনে ক্যানভর্তি পেট্রোল নিয়ে আরেকটি দল আসছিল। যারা পালাতে চেষ্টা করল তাদের গুলি করা হলো। আর যারা গৃহাভ্যন্তরে থেকে গেল, তারা জীবন্ত পুড়ে কয়লা হয়ে গেল। আমরা সব মিলিয়ে ধারণা করলাম, ১২টা থেকে ২টার মধ্যে সেখানে ৭০০ নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হলো।
শনিবার সকালে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর একটি বাজারে তার লোকদের খুঁজে বেড়াচ্ছিল; আমাকে বললো, আমি আমার কনস্টেবলদের খুঁজছি। আমার থানায় ২৪০ জন কনস্টেবল ছিল। এ পর্যন্ত আমি ৩০ জনকে খুঁজে পেয়েছি। বাকিরা নিহত হয়েছে। আমি এরপর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গেলাম। দেখলাম সেখানে কোনো আর্মি বা নিরাপত্তা বাহিনীর লোক নেই। পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। আমি বাড়ির আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বললাম। তারা আমাকে আগের রাতের ঘটনা জানাল। আমি জানতে পারলাম, মুজিব পুরোপুরি সুস্থ। তিনি আহত বা নিহত নন। তাকে বন্দী করা হয়েছে। আমি ও মিশেল তখন পুরোপুরি ভয়ার্ত ছিলাম। আমরা ঘটনার পরিক্রমায় বেশ ভয়ই পাচ্ছিলাম। একদিকে সাংবাদিক হিসেবে আমাদের ঢাকায় থাকার অধিকার নেই, তারপরও আবার মূল অফিসের সঙ্গে আমাদের কোনো রকমের যোগাযোগ নেই। আমরা ৩২ নম্বর থেকে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এলাম, বেশকিছু ছবি তুললাম। আমরা নিশ্চিত যে, হোটেলে ফিরে গেলে আর বের হতে পারব না। তাই যতটা পারা যায় তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করলাম। আমরা নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত চলে গেলাম। অনেক ছবি তুললাম। পরে বিকালের পর হোটেলে ফিরে এলাম।
বাঙালি কর্মচারীরা আমাদের জানাল, আর্মি দুই দফা চেক করে গেছে। কেউ আছে কিনা দেখতে। বাঙালি কর্মচারীরাই এবার আমাদের দু’জনকে টেবিলের নিচে ঢুকিয়ে রাখল। এরপরও আর্মি এলো, তখন আমাদের রান্নাঘরে কাবার্ডে লুকিয়ে রাখল। সেখানে দেখলাম আরও দুই জার্মান নাগরিককে। বাঙালিরা আমাদের অনেক সাহায্য করল। কিন্তু আমাদের মূল সমস্যা ছিল, কিভাবে বাইরে নিউজ পাঠাতে পারব সেটা নির্ধারণ করা। আবার কিভাবে ঢাকা থেকে বের হব, তা খুঁজে দেখা। সেজন্য আমি ব্রিটিশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করলাম। আমি ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ ব্যবহার করতে চাইলাম। কিন্তু টিপিক্যাল ব্রিটিশ হাইকমিশনার আমাকে বলল, না না। তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে। এটা সম্ভব নয়। তুমি ব্রিটিশ নাগরিক, তোমার উচিত এখনই দেশ ত্যাগ করা। তখন হোটেলে থাকা ওই জার্মান যুগল আমাদের সমস্যাটা বুঝল। তারা আমাদের ছবির ব্যাগটা তাদের কাছে নিয়ে সাহায্য করতে চাইল। পরে একসঙ্গেই এয়ারপোর্ট গেলাম। ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে অনুরোধ করে মোট আঠারো ব্যাগ ছবির নয়টি দিলাম ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে লন্ডনে নেওয়ার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, আমি বা আমরা সেই নয় ব্যাগ ছবি আর পাইনি। পরে এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন কোনো ঝামেলা করল না। তবে কাস্টমস আমাদের বেশ ভালো করে চেক করল। দুই দফায় পুরো উলঙ্গ করে চেক করা হলো। আমি আমার নোটসগুলো মোজার মধ্যে লুকিয়ে রাখলাম। কিছু রাখলাম কোমরের বেল্টের নিচে। যখন পুরো কাপড় ও জুতা খুলে ফেলতে হলো তখনো বেশ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম। মোজা-বেল্ট খুলে রাখার পর তারা তা চেক করল না। তবে বিপদ হলো, যখন আবার মোজা পরতে গেলাম। তখন পেঁচানো কাগজগুলো মোজার মধ্যে স্পষ্ট হলো। এরপর তারা মোজার কাগজগুলো নিয়ে নিল। আমাকে আবার চেক করা হলো।
একপর্যায়ে পায়ুপথ দিয়ে লাঠিও প্রবেশ করিয়ে চেক করা হলো। কিন্তু আমার বেল্টের নিচে যে নোটগুলো ছিল সেগুলো থেকে গেল। আমরা দু’জন ঠিক করেছিলাম করাচি যাব না, যাব কলম্বো। কারণ করাচি গেলে আমাদের আবার যদি সেখানেই আটক রাখা হয়, এমন ভয় কাজ করছিল মনে। পরে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সহায়তায় নিরাপদেই আমরা পাকিস্তান এয়ারওয়েজের একটি বিমানে করে কলম্বো যাই। সেখান থেকে যাই ব্যাংকক। এয়ারপোর্টে এক দাড়িওয়ালা আর্মি অফিসার আমাকে বলে, আল্লার নামে ও অভিন্ন পাকিস্তানের জন্য যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা আমরা জিতবই। প্রয়োজনে পূর্ব পাকিস্তানকে ধ্বংসস্তূপ বানানো হবে, তারপরও পাকিস্তান ভাঙতে দেওয়া হবে না।
সেখান থেকেই টেলিগ্রাফে আমার নিউজের সূচনায় ‘এক ঈশ্বর এবং এক পাকিস্তানের নামে শপথ করা’র বিষয়টি উল্লেখ করেছি। মাত্র ২৫ বছর বয়সে এটা আমার সাংবাদিকতা জীবন ও মানবিক জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অর্জন। তবে নিজের জন্য এটা ভাবতেই ভালো লাগে যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানে চালানো ধ্বংসলীলার বিষয়টি থেকে বিশ্ববাসীকে অন্ধকারে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার রিপোর্ট দিয়ে বিশ্ববাসীকে জঘন্যতম এ গণহত্যার কথা জানাতে চেয়েছিলাম। সেই সঙ্গে বাংলাদেশিদের নিজেদের লাল-সবুজ পতাকার জন্য যে স্পৃহা কাজ করছিল, তারা যে উদ্যমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তা আমি বিশ্ববাসীকে জানাতে পেরেছি। সেই সঙ্গে আমার আরও ভালোলাগার বিষয় হলো, আমি বাংলাদেশের বিজয়ের দিনও উপস্থিত ছিলাম।
তখন আমি কলকাতা থেকে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকায় আসি। তখন আর্মির সেই মেজর সালেক সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা হয়। তাকে বলি, আমি যদি ফিরে না যেতাম, তবে কি হতো? সে আমাকে উত্তর দেয়, তুমি মারা পড়তে।
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আর্মির যুদ্ধে তুমি ক্রসফায়ারে পড়তে। তুমি মারা যেতে। এরপর আরও কয়েক সপ্তাহ ঢাকায় থাকি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারিতে দেশে ফিরে আসেন, তখনও আমি উপস্থিত ছিলাম। দেখলাম স্বাধীন দেশের মানুষ তার নেতাকে কিভাবে বরণ করে নেয়। আমি তাকে অভিনন্দন জানাই। কিন্তু সেদিন আমার জন্মদিন ছিল, কিন্তু কিভাবে যেন বঙ্গবন্ধু সেটা মনে রেখেছিলেন। তিনি তার এক কর্মীকে ডেকে কেক নিয়ে আসেন এবং কেক কাটার ব্যবস্থা করেন। সবকিছুই আমার জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। স্বাধীন এক দেশ, তার জন্মদাতা ও আমার প্রতি সেই দেশের মানুষের ও নেতার ব্যবহার আমাকে অভিভূত করে।
এমএআর/আরএস