জরাজীর্ণ ভবনে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস


প্রকাশিত: ০৭:৪৩ এএম, ১৭ মার্চ ২০১৭

সরু গলি, রিকশায় পথচলা। দু’পাশে আকাশ ছোঁয়া সারি সারি বহুতল ভবন। কোনটির খোলস উঠা আবার কোনটিতে বড় বড় ফাটল। দেখলে বোঝার উপায় নেই, এসব ভবনে মানুষের বসবাস। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে কোন কোনটির সামনে বড় অক্ষরের সাইনবোর্ডও রয়েছে। অথচ সেসব ভবনেই বসবাস করছে হাজার হাজার পরিবার।

একটু সামনে এগুতেই দীর্ঘ জট। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, বিপরীত দিক থেকে অপর একটি রিকশা ঢুকে পড়েছে গলিতে। এমন চিত্র ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পুরান ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার। সূত্রাপুরসহ এর আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠিত ৪৩নং ওয়ার্ড।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজধানী ঢাকায় ৭-এর অধিক মাত্রায় ভূমিকম্প হলে এসব ভবন মুহূর্তেই ধসে পড়বে। ভূমিকম্প ছাড়াও যে কোন মুহূর্তে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে পুরান ঢাকার এই এলাকায়। শুধু ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নয়, এই এলাকায় রয়েছে উন্নয়নের অভাবও। সামান্য বৃষ্টিতেই জমে হাঁটুপানি। নেই ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা। পানি ও গ্যাসের সংকটও প্রকট। সকাল ৭টার পর বিকাল অবধি গ্যাসের সন্ধান মেলে না। পানিতে রয়েছে তীব্র দুর্গন্ধ। ময়লা-আবর্জনা আর কাদামাটিতে ভরা ওয়াসার পানি নিয়ে অভিযোগের কমতি নেই স্থানীয়দের। এমন পানি দিয়েই গৃহস্থলির কাজ সারতে হয়। এই ওয়ার্ডে নেই সিটি কর্পোরেশনের কোনো খেলার মাঠ, কমিউনিটি সেন্টার ও পার্ক। একটি কাঁচাবাজার থাকলেও নেই সঠিক ব্যবস্থাপনা।

ওয়ার্ড পরিচিতি
সূত্রাপুর থানার পাতলা খান লেন, শ্যামা প্রসাদ চৌধুরী লেন, কে জি গুপ্ত লেন, শ্রী দাস লেন, ঈশ্বর দাস লেন, পি সি ব্যানার্জী লেন, গোপাল সাহা লেন, প্রতাপ দাস লেন, নর্থ ব্রুক হল রোড, প্যারী দাস রোড, হেমেন্দ্র দাস রোড, জয়চন্দ্র ঘোষ লেন, হরিষ চন্দ্র বসু স্ট্রিট, রুপচাঁন লেন, বাগানবাড়ীসহ রুপলাল, শুকলাল দাস লেন, দেবেন্দ্র নাথ দাস লেন, মোহিনী মোহন, মদন সাহা লেন, আনন্দ মোহন, ফরাস গঞ্জ লেন, মালাকার টোলা লেন, উল্টিন গঞ্জ, ফরাশগঞ্জ রোড ও ফরাশগঞ্জ লেন এবং বি কে দাস এলাকা নিয়ে দক্ষিণ সিটির ৪৩নং ওয়ার্ড গঠিত। এই ওয়ার্ডে ২৩ হাজার ভোটারের পাশাপাশি ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ বসবাস করছেন।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরান ঢাকার এই এলাকায় ৬০ ভাগের বেশি ভবন রয়েছে ভয়াবহ ঝুঁকিতে। এসব ভবনে বসবাস করছেন দুই লক্ষাধিক মানুষ। ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবন সংস্কারের জন্য নেওয়া হচ্ছে না বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ। বাড়ীর মালিকদের নোটিশ দেয়া হলেও তারা তা মানছেন না। ফলে চরম জীবনাশঙ্কায় রয়েছেন বাড়ীমালিক ও ভাড়াটিয়ারা।

সরেজমিন দেখা গেছে, এলাকার প্রবেশপথগুলো একেবারেই সংকীর্ণ। অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। রাস্তার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা রাখা হয়নি। যে কারণে পুরো ওয়ার্ডের বেশির ভাগ সড়কই সংকীর্ণ। পাশাপাশি দুটি রিকশার একসাথে যাতায়াতের কোনো উপায় নেই। রাস্তায় ফুটপাত না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন স্থানে রাস্তার উপরই গড়ে উঠেছে অবৈধ দোকানপাট।

সরু গলির কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সসহ বড় ধরনের কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে পারে না। একযোগে গলিগুলোর দুই মুখ দিয়ে দুটি রিকশা প্রবেশ করলে লেগে যায় যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও মেলে না মুক্তি।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পাশাপাশি এখানে মাদকের বিস্তারও প্রকট। সন্ধ্যা হলেই মাদকসেবীরা এলাকার বিভিন্ন সড়ক ও মোড়ে অবস্থান নেয়। এসব স্থানে প্রকাশ্যে চলে মাদকসেবন ও ব্যবসা। ব্যক্তিমালিকানায় মুক্তি খেলাঘর নামে একটি ছোট মাঠ থাকলেও সেটি পরিণত হয়েছে মাদকসেবীদের আড্ডায়। ফলে সন্তানদের নিয়ে বেকায়দায় রয়েছেন অভিভাবকরা।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও ডেসার অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক জাগো নিউজকে বলেন, প্রাচীনকালে অপরিকল্পিতভাবে এখানে রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়। তখন যে যেভাবে পেরেছে বাড়িঘর নির্মাণ করেছে। রাস্তার জন্য কেউ বেশি জায়গা রাখেনি। পাশাপাশি দুটো রিকশা চলারও জায়গা নেই। কেউ অসুস্থ হলে কিংবা আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকারও জায়গা নেই।

খেজুরবাগ থেকে পানি নিতে আসা হাছান আলী, মো. হাসেম ও লাভলী আক্তার জানান, তারা প্রায়ই পাম্প থেকে পানি নিতে আসেন। বাসায় পানি না থাকলে বাড়ীর মালিকরা নিজেদের ব্যক্তিগত মোটর দিয়ে পানি তোলেন কিন্তু ভাড়াটিয়া হওয়ায় তাদের পানি দেয়া হয় না। ওয়ার্ডে গ্যাসের সমস্যাও প্রকট। সকাল থেকে বিকেল পযর্ন্ত প্রায় সময় গ্যাস থাকে না। কখনো কখনো থাকলেও তা মোমবাতির মত জ্বলে।

এই ওয়ার্ডে ডিএসসিসির কোনো মাঠ ও পার্ক নেই। শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ ও চিত্তবিনোদনের জন্য মুক্তি খেলাঘর নামে ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি মাত্র মাঠ থাকলেও সেটা এখন খেলার মাঠ বলার কোনো উপায় নেই। সেখানে কেবল মাদকসেবীদের আড্ডা। ফলে ছোট ছোট শিশুরা ব্যাট-বল ও ফুটবল নিয়ে অলি-গলিতে দাঁপিয়ে বেড়ায়।

ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী নেওয়ামুল কবির বলেন, এলাকার খেলার মাঠটি মাদকসেবীদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। এ কারণে আমরা এখন আর সেখানে যাই না। এলাকার বিভিন্ন গলিতে বিকেলে খেলাধুলা করি।

পাতলা খান লেনের বাসিন্দা আশরাফুল আলম বলেন, আমি এই ওয়ার্ডে প্রায় ১৯ বছর ধরে ব্যবসা করছি। এলাকার সমস্যাগুলো সম্পর্কে আমি কিছুটা জানি। পুরো ওয়ার্ডে খেলার মাঠ একটি। সেটাও মাদকসেবীদের দখলে। উঠতি বয়সী কিশোর-যুবকদের সময় কাটানোর কোনো মাধ্যম নেই। ফলে তারা মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

মদন সাহা লেনের ২৪নং বাড়ীর সামনে সিটি করপোরেশনের পক্ষে নোটিশ টানিয়ে ময়লা-আবর্জনা যত্রতত্র না ফেলার অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু নোটিশের নিচেই ময়লার স্তুপ করে রাখা হয়েছে। সানিয়াত আলী ভূঁইয়া নামের এক বাসিন্দা তা দেখিয়ে বলেন, যত দিন মানুষ সচেতন না হবে তত দিন ওয়ার্ডটি পরিপাটি রাখা যাবে না।

তবে ওয়ার্ড পরিদর্শক আবু তাহের ও ওয়ালী জসিম জাগো নিউজকে বলেন, মাস কয়েক আগেও যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা হতো। এখন বেশ পরিপাটি। প্রায় সব রাস্তাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বাসাবাড়ী থেকে সংগ্রহ করা বজ্য রাখার জন্য একটি সেকেন্ডারি টান্সফার স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। যা উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। ফলে এখনও সড়কে রাখতে হচ্ছে ময়লার কনটেইনার।

তারা আরো বলেন, পুরাতন ড্রেনেজ ব্যবস্থাও সংস্কার করা হয়েছে। ওয়ার্ডটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রতিদিন প্রায় ৮০ পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। ওয়ার্ডের ২৬টি লেন ৫টি ইউনিটে ভাগ করে প্রতিদিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। কিন্তু বাসিন্দারা বিনে ময়লা না ফেলে যত্রতত্র ফেলছে। ফলে চেষ্টা থাকলেও আমরা পুরোপুরি সফল হতে পাচ্ছি না। এ কারণে নিরুপায় হয়ে সেকেন্ডারি টান্সফার স্টেশন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন কাউন্সিলর।

ওয়ার্ডের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে কাউন্সিলর হাজী আরিফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর ইতোমধ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ৫০ ভাগ কাজ সম্পন্ন করেছি। পানির সংকট সমাধানে আগামী এপ্রিলের মধ্যে সিরিশ লেনে নতুন একটি পানির পাম্প স্থাপন করা হবে। সড়কবাতি, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, যত্রতত্র ময়লা ফেলা নিয়ন্ত্রণসহ জনদুর্ভোগ কমাতে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

তিনি আরো বলেন, ওয়ার্ডের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগামী মাসে আমার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ৩২টি সিসি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিষয়ে এ মাসের (মার্চ) শেষ নাগাদ ডিএসসিসি ও রাউজকের (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) সাথে সমন্বয় করে অভিযান পরিচালনা করা হবে।

এলাকায় মাদকের বিস্তারের বিষয়টি স্বীকার করে কাউন্সিলর আরিফ হোসেন বলেন, আশক্তরা মাদকসেবী থেকে ব্যবসায়ী হয়ে উঠছে। স্থানীয় হওয়ায় তাদের ভয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না। মাদক ব্যবসায়ীদের নির্মূলে আইন আরো কঠোর হওয়া উচিত। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

রাস্তার উপর অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদে আগামী ডিসেম্বরে ডিএসসিসি অভিযান পরিচালিত করবে। এছাড়া ওয়ার্ডে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। বাকি সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে যাবে বলে এলাকাবাসীকে আশ্বস্ত করেন কাউন্সিলর আরিফ হোসেন।

এমএসএস/এমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।