বন্ধুর হাত ধরেই মাদকের কবলে শিশুরা
ভালো-মন্দের বিবেচনাবোধ তৈরির আগেই অনেক শিশু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরিবার থেকে। অনেকে পারিবারিক কলহ ও অশান্তির কারণেও বিচ্ছিন্ন হয়। এরপর জীবিকার তাড়নায় তাদের জড়াতে হয় নানা কাজে। হাতে অর্থ আসতে শুরু হলে শুরু হয় অবক্ষয়ও। স্বাভাবিক জীবনের পরিবর্তে এসব শিশু মাদক গ্রহণ শুরু করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গবেষণা অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১৫ বছরের নিচে মোট ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ শিশু মাদকের ভয়াল ছোবলের শিকার। কেন এই অবক্ষয়? তা নিয়ে জাগো নিউজে থাকছে চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ দ্বিতীয় পর্বে থাকছে বন্ধুদের প্ররোচনায় মাদকের অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া বারেকের গল্প।
ভোলার নাজিরপুর গ্রামে জন্ম বারেকের। বয়স ১২। বাবা-মা ঢাকাতেই আছেন। তবে ৪ মাস ধরে মা-বাবাকে ছেড়ে সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে থাকছে সে। যাত্রীদের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিকের বোতল কুড়ানোর পাশাপাশি সেগুলো বিক্রির টাকা দিয়ে গাঁজা আর সিগারেট কিনে খায় সে। সদরঘাটের পথশিশুদের জনপ্রিয় মাদক ‘ড্যান্ডিও’ খেতো সে। অবশ্য এখন ড্যান্ডি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে বলে দাবি তার।
মাদক সেবনের বিষয়ে আলোচনায় বারেকের আত্মবিশ্বাস দেখে সরাসরি প্রশ্ন করা হলো, ‘কেন নেশা করো?’ এক বাক্যে উত্তর দিল, ‘খেতে ভালো লাগে, সবাই খায়, তাই আমিও খাই।’
সদরঘাটের প্রায় ৫০০ পথশিশুর মধ্যে বারেক অন্যতম। পথশিশুদের মাদকাসক্ত হওয়ার ভিন্ন ভিন্ন কারণ থাকলেও বারেকের কোনো কারণ নেই। মাদকাসক্ত বন্ধুদের সংস্পর্শে এসেই সে এ পথে পা বাড়িয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৮৫ ভাগ মাদকাসক্ত শিশু বারেকের মতো বন্ধুদের প্ররোচনায় এ পথে পা বাড়িয়েছে। আর বাকিদের ১১ ভাগ শিশু ‘কৌতূহলবশত’ মাদক সেবন করে।
বারেকের দৈনিক আয় সর্বোচ্চ ১২০ টাকা। এর অর্ধেকের বেশি খরচ হয় মাদক কিনতে। বারেকের বাবা-মা ঢাকায় থাকেন। দু’জনই কাজ করেন। তবু মাদকের টানে বন্ধুদের নিয়ে সদরঘাটে রাত কাটায় বারেক।
কেন মা-বাবাকে ছেড়ে সদরঘাটের এই ঝুপড়ি বাড়িতে থাকো? উত্তরে বারেক বলে, ‘এখানে অনেক বন্ধু হয়েছে। সবাই একসঙ্গে রাত জেগে নেশা করি। মাঝে মাঝে না খেলে মাথা ঘোরায়। অস্থির লাগে। তাই আর বাড়ি যাই না, সদরঘাটেই থাকি।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক জরিপে দেখা গেছে, সদরঘাটের অধিকাংশ শিশুই গাঁজা খেয়ে নেশা করে। তবে সস্তা হওয়ায় পথশিশুদের সবচেয়ে ‘প্রিয়’ ড্যান্ডি। শিশুসহ বর্তমানে দেশের প্রায় ০.৫ শতাংশ মাদকাসক্ত ড্যান্ডি খায়।
বেসরকারি একটি সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, সদরঘাটে শিশুদের সংখ্যা প্রায় ৫০০। এদের প্রায় ৯৮ শতাংশই মাদক সেবন ও কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত। এদের দলে নিয়মিতই নতুন শিশু যোগ হচ্ছে।
সদরঘাটের পথশিশুরা যেন পথভ্রষ্ট না হয়, সেজন্য একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের পাশে একটি স্কুল করা হয়েছে। তবে সদরঘাটে পথশিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই স্কুলের বিষয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এদের মধ্যে ৩ জন কয়েকবার স্কুলে গিয়েছিল। কিন্তু আগ্রহ না থাকায় নিয়মিত যায় না।
অভিভাবক এবং সংশ্লিষ্টদের নজর না থাকায় আজ এই শিশুরা সঠিক বন্ধু নির্বাচন করতে পারছে না। মাদকের পথে ঢুকে তারা এর মাশুল গুনছে।
এ বিষয়ে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. এম এ আজিজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা সত্যি যে আমাদের শিশুরা অনুকরণ করতে পছন্দ করে। সমবয়সী এক শিশু যা করে তা অন্য শিশুরাও দেখে অনুকরণ করার চেষ্টা করে। আগামীর সুস্থ স্বাভাবিক সমাজ বিনির্মাণে মাদকাসক্ত পথ শিশুদের রক্ষার উদ্যেগ নেয়া জরুরি। কারণ শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই আমাদের ভবিষ্যৎ বির্নিমাণে তাদের সুস্থ জীবন যাপন করার জন্য প্রতিটি সচেতন নাগরিককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে।’
ছোটকাল থেকেই এমন নেশার কারণে বারেকের মতো আগামী প্রজন্মের শিশুরা অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ জাগো নিউজকে বলছিলেন, ‘পথশিশুরা যদি নিয়মিত মাদক সেবন করে থাকে, তার ফল জাতির ভবিষ্যতের জন্য খুব ভালো নয়। এসব শিশুদের দেখে সমাজের অন্য শিশুরাও মাদক সেবনে উদ্বুব্ধ হতে পারে।’
পথভ্রষ্ট এসব শিশুদের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ছাড়াও কয়েকটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে সেগুলোর কোনোটিতেই যেতে তাদের আগ্রহ হয় না।
কেন স্কুলে যাও না? জানতে চাইলে বারেক বলে, ‘স্কুলে গেলে সময় নষ্ট। কাজ করতে পারি না, পেটে খাওয়াও জোটে না। তাই সারাদিন এখানেই থাকি।’
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) নজরুল ইসলাম শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে অধিদফতরের পক্ষ থেকে নানা ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। মাদকাসক্ত নিরাময়ের জন্য প্রতিটি সরকারি নিরাময় কেন্দ্রে শিশুদের জন্য ১০টি করে বেড রয়েছে। সেখানে অনেকেই ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে।’
মাদকসেবী পথশিশুদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনা খুব কষ্টের বিষয় নয়। সমাজের উচ্চবিত্তদের সহযোগিতা, জ্ঞানীদের জ্ঞান বিতরণ ও প্রচার প্রচারণার মাধ্যমেই এর সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন মনোবিদ অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ।
• প্রথম পর্ব: মায়ের ওপর বাবার নিপীড়ন ভুলতে মাদক নেয় মেহেদী
এআর/এসএম/এনএফ/পিআর