মায়ের ওপর বাবার নিপীড়ন ভুলতে মাদক নেয় মেহেদী

আদনান রহমান
আদনান রহমান আদনান রহমান , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৭:২২ এএম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ভালো-মন্দের বিবেচনাবোধ তৈরির আগেই অনেক শিশু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরিবার থেকে। অনেকে পারিবারিক কলহ ও অশান্তির কারণেও বিচ্ছিন্ন হয়। এরপর জীবিকার তাড়নায় তাদের জড়াতে হয় নানা কাজে। হাতে অর্থ আসতে শুরু হলে শুরু হয় অবক্ষয়ও। স্বাভাবিক জীবনের পরিবর্তে এসব শিশু মাদক গ্রহণ শুরু করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গবেষণা অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১৫ বছরের নিচে মোট ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ শিশু মাদকের ভয়াল ছোবলের শিকার। কেন এই অবক্ষয়? তা নিয়ে জাগো নিউজে থাকছে চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ থাকছে প্রথম পর্ব

জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী ১৮ বছর বা তার কম বয়সীদের শিশু বলা হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি শিশু রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগ। এসব শিশুর অধিকাংশেরই অক্ষরজ্ঞান থাকলেও নানা কারণে তারা স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে।

রাজধানীর সদরঘাটে আস্তানা এমন পাঁচ শতাধিক শিশুর। তাদের একজন ভোলার মেহেদী হাসান। বয়স ১০-১২ হবে। সকাল থেকে অন্য পথশিশুর মতো বোতল কুড়ানোর কাজ করলেও তার দিনের শেষটা কাটে মাদকের অন্ধকার দুনিয়ায়। সপ্তাহে দু-একদিন পথশিশুদের ‘জনপ্রিয়’ মাদক ড্যান্ডি খায় মেহেদী। প্রতি রাতে গাঁজা, দিনে দু-এক ঘণ্টা পর পর সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস তার।

মেহেদীর সরল স্বীকারোক্তি, ‘যখন থেকে বুঝতে শিখছি তখন থেইক্কাই ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হমু, বিমান চালামু, আরো কত কী! এখন তো ইচ্ছা হয় খারাপ হমু, খারাপ কাজ করমু।’
 
একসময় বৈমানিক হওয়ার স্বপ্ন দেখা মেহেদীর কেন আজ এ দশা? কেন জীবনের প্রতি এমন ক্ষোভ? কেনই বা মাদক সেবনের মাধ্যমে নেশার ঘোরে পড়ে থাকতে হয় তাকে? উত্তর খুঁজতে মেহেদীর সঙ্গে ৩ ঘণ্টা কাটলো সদরঘাটে।

অনেক কথা বলার মাঝে সরাসরি মেহেদীকে প্রশ্ন করা হলো, নেশা করে কী মজা? উত্তর দিতে ৩ সেকেন্ডও সময় নিলো না সে। বললো, ‘সিগারেট খাই চিন্তা কমানোর লাইগা। গাঁজা খাই কষ্ট ভুলার লাইগা, মায়েরে না দেখার কষ্ট।’

এবার মেহেদী তার নিজের চাপা কষ্ট জানাতে শুরু করলো। বাবা বেল্লাল চট্টগ্রামে সিএনজি চালান। মা হাসিনা বেগম মানসিক রোগী। মেহেদীর ভাষায়, ‘পাগল’। মেহেদীর মাদক সেবনের কারণের সঙ্গে অবশ্য তার মায়ের ‘পাগল’ হওয়ার একটা যোগসূত্র আছে।

মেহেদী ছোট থেকেই দেখছে তারা বাবা-মায়ের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ। বাবা আরেকটা বিয়ে করতে চাইতেন। এ নিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে মাকে মারধর করতেন তার বাবা। মায়ের ওপর ক্ষোভ ঝাড়তে পেটানো হতো মেহেদীকেও।

মেহেদীর কথা, এসব দেখে আমার ৭ বছরের একমাত্র ছোট বোন সাথী খুব কাঁদতো। তবুও মাকে ছাড়তো না বাবা। মার খেতে খেতে মা একদিন পাগলের মতো হয়ে যায়। এসব দেখেই একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে লঞ্চে ঢাকা আসি।

ঢাকায় পৌঁছানোর আগে কোনো এক সময় চট্টগ্রামের একটি স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ক্লাস ওয়ানে উঠেছিল মেহেদী। তবে ওয়ানে একদিনও ক্লাস করার সৌভাগ্য হয়নি তার। শিক্ষার আর কোনো আলোই তার ওপর পড়েনি।

ঢাকায় এসে নানা চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে মেহেদীকে। কাজের সন্ধানে কমলাপুর, বিমানবন্দর, টঙ্গী স্টেশন থেকে সিলেট রেলস্টেশন পর্যন্ত গেছে সে। তবে সবশেষে গন্তব্য হয়েছে সদরঘাট। এ এলাকায় বোতল টোকায় সে। বোতল বিক্রি করে দিনে আয় করে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এর মধ্যে সিগারেট-গাঁজায় দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ টাকা খরচ হয় তার। কোনোদিন টাকার ‘টান পড়লে’ টার্মিনালে চুরি করতেও দ্বিধা করে না মেহেদী ও তার বন্ধুরা।

MEHEDI

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে যেখানে মেহেদীদের মতো বৈমানিক হওয়ার স্বপ্ন দেখা শিশুদের অগ্রভাগে থাকার কথা, সেখানে কেবল পারিবারিক দ্বন্দ্বে যেন অতলে তলিয়ে যাচ্ছে তারা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৫ সালে মেহেদীর মতো দেশের প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ শিশু পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং হতাশার কারণে মাদকের পথে পা বাড়িয়েছে।
 
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, পথশিশুরা প্রধানত মানসিক যন্ত্রণা ও সামাজিক অবস্থানের কারণে মাদক সেবন করে। আমরা বেশ কিছু বিষয় পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি পথশিশুরা বেশি দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণায় ভোগে। তারা ভাবে, মাদক নিলে এসব দুঃখ কষ্ট থেকে বাঁচা যাবে। এছাড়া পথশিশুদের সামাজিকভাবে কোনো অবস্থান নেই। তারা ইচ্ছা করলেই যা খুশি তা করতে পারে। তাই পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এসব বিপদগামী শিশুকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে।

মেহেদীর মতো পথশিশুদের মাদক নেয়ার কারণ আর যাই হোক না কেন, এর পেছনে অবশ্যই তাদের বাবা-মার অবজ্ঞা-অবহেলা বা দ্বন্দ্বের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন ড. নূর মোহাম্মদ।
 
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ২০১৫ সালের ‘মাই ড্যাড ওয়ান্ডারফুল’ স্বীকৃতি পাওয়া নাট্যব্যক্তিত্ব ও সফল বাবা ড. ইনামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, শিশুমন স্পর্শকাতর। তাদের মনে অন্যরকম একটা আবেগ কাজ করে। একটি সন্তানের মাদকের পথে পা বাড়ানোর পেছনে শতভাগ দায় বাবা-মার বলে আমি মনে করি। বাবা-মার পর্যাপ্ত দেখভালের অভাবেই তারা এ পথে ধাবিত হচ্ছে। বাবা-মার উচিত তাদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখা।

এআর/এসএম/এআরএস/এনএফ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।