বছর ঘুরতেই বায়রা লাইফের ৮২ শতাংশ পলিসি উধাও
চরম দুরাবস্থা বিরাজ করছে বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানি বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে। ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে প্রিমিয়াম আয়। এমনকি এক বছর আগে যেসব পলিসি বিক্রি করা হয়েছে তার সিংহভাগই নবায়ন হচ্ছে না। আয় না থাকায় ব্যবস্থাপনা ব্যয় মেটাতে আইন লঙ্ঘন করে সীমার অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সেইসঙ্গে ভেঙে খাওয়া হচ্ছে বিনিয়োগের টাকা।
প্রতিষ্ঠানটি এতটাই নাজুক অবস্থায় আছে, বছরে যে ব্যবসা করছে ব্যবস্থাপনা খাতেই ব্যয় হচ্ছে তার থেকে বেশি। সম্প্রতি ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন সূচক নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির তৈরি করা প্রতিবেদন থেকে এই বেহাল দশার চিত্র পাওয়া গেছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বায়রা লাইফ প্রথম বর্ষ ও নবায়ন প্রিমিয়াম মিলিয়ে ব্যবসা করেছে ১৮ কোটি ৮ লাখ টাকার; যা ২০১৫ সালে ছিল ২১ কোটি ১ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির প্রিমিয়াম সংগ্রহ কমেছে ২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
প্রতিষ্ঠানটির প্রিমিয়াম সংগ্রহের ক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি বেহাল দশা বিরাজ করছে নবায়নের ক্ষেত্রে। ২০১৫ সালে যেখানে ১৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ হয়েছিল, এক বছর পর ২০১৬ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ কোটি ৬ লাখ টাকায়। এর মধ্যে ২০১৫ সালে যে পলিসি বিক্রি হয়েছিল তার ৮২ শতাংশই ২০১৬ সালে নবায়ন বাবদ আদায় হয়নি।
২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি নতুন পলিসি বিক্রি করে ৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা সংগ্রহ করে বলে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) জানায়। তবে ২০১৬ সালের নবায়ন প্রিমিয়ামে এর মাত্র ১৮ শতাংশ বা ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা আদায় হয়েছে।
বীমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক বছরের ব্যবধানে ৮২ শতাংশ পলিসি বন্ধ হয়ে যাওয়া বিস্ময়কর। এমন অবস্থা চলতে থাকলে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দুরূহ হয়ে পড়বে। এমনও হতে পারে কোম্পানিটি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় হিসেবে ভুয়া প্রিমিয়াম আয় দেখিয়ে কোম্পানি থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। কারণ আইন অনুযায়ী প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতে ৩৫ শতাংশই এজেন্ট কমিশন বাবদ খরচ দেখানো যায়। অর্থাৎ ১ কোটি টাকা ভুয়া ব্যবসা দেখালে কমিশন বাবদ ৩৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া সম্ভব।
তাদের মতে, যদি ভুয়া ব্যবসা দেখিয়ে কোম্পানি থেকে টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটে তবে বীমা গ্রাহকদের অর্থ মারাত্মক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। আইডিআরএ’র উচিত দ্রুত প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক অবস্থা খতিয়ে দেখার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ সালে বায়রা লাইফ প্রথম বর্ষ ব্যবসা সংগ্রহ করেছে মাত্র ৯ কোটি ২ লাখ টাকা। আর ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করেছে ১৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আইন অনুযায়ী বছরটিতে ব্যবস্থাপনা খাতে কোম্পানিটি সর্বোচ্চ ব্যয় করতে পারে ৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। সে হিসাবে ২০১৬ সালে অবৈধভাবে খরচ করা হয়েছে ৫ কোটি ৩ লাখ টাকা।
শুধু ২০১৬ সালে নয়, বছরের পর বছর প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনা খাতে এভাবে অবৈধ ব্যয় করছে। এর আগে ২০১৫ সালে ৩ কোটি ৮১ লাখ, ২০১৪ সালে ৪ কোটি ১০ লাখ, ২০১৩ সালে ৯ কোটি ১০ লাখ, ২০১২ সালে ৮ কোটি ৩৬ লাখ, ২০১১ সালে ৫ কোটি ৭৩ লাখ, ২০১০ সালে ৯৮ লাখ টাকা ব্যবস্থাপনা খাতে অবৈধ খরচ করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির আয় কমে যাওয়া এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করার কারণে বিনিয়োগ ভাঙতে হচ্ছে। ২০১৫ সাল শেষে বায়রা লাইফের বিনিয়োগ ছিল ৮১ কোটি ৮ লাখ টাকা; যা ২০১৬ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭৮ কোটি ৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগ উঠিয়ে নেয়া হয়েছে ৩ কোটি ৩ লাখ টাকা।
এদিকে দুর্বল আর্থিক অবস্থার কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারেনি কোম্পানিটি। ফলে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রতিদিন জরিমানা গুণতে হচ্ছে কোম্পানিটিকে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হওয়ার কারণে প্রতিদিন জরিমানা দিতে হচ্ছে ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ বছরে ১৮ লাখ টাকা জরিমানা গুণতে হচ্ছে বায়রা লাইফকে।
এসব অনিয়মের বিষয়ে বায়রা লাইফের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সুশান্ত কুমার প্রামাণিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এমএএস/জেডএ/আরআইপি