মান্ডা খাল ঠান্ডা হওয়ার গল্প


প্রকাশিত: ০৬:১২ এএম, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

দখল আর দূষণে হারিয়ে যাচ্ছে রাজধানীর খালগুলো। প্রবাহমান শতাধিক খালের মধ্য থেকে এখন এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬টিতে। দখলদারদের কবল থেকে রাজধানীর খালগুলো রক্ষা করতে একাধিক উদ্যোগ নেয়া হলেও সুফল আসেনি। ভূমিদস্যুদের বলয়গ্রাসে বিলীন হতে চলেছে নগরীর পানি নিষ্কাশনের এ মাধ্যমগুলো। ফলে বাড়ছে জলাবদ্ধতা। নেমে যাচ্ছে ভূপৃষ্ঠের পানির স্তর। নগরীর খালগুলো নিয়ে জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহেদ শফিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব
 
খুব বেশি দূরের কথা নয়, আশির দশকের দিকেও তীব্র প্রবাহ ছিল রাজধানীর মান্ডা খালে। মাছধরা নৌকা, মালবাহী ট্রলার ও খেকশিয়ালের ডাকে ঘুম ভাঙতো এলাকাবাসীর। স্রোতের শব্দে ঘুম পাড়তো খাল পাড়ের মানুষ। স্রোতের টানে খালপাড়ের বিভিন্ন অংশ ভেঙেও পড়েছে। কিন্তু গরম সেই মান্ডা খাল এখন ঠান্ডা। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর দখলদারদের দৌরাত্ম্যে অস্তিত্ব বিলীনের পথে ঐতিহ্যবাহী এ খালটি।

Manda
 
পূর্ব ঢাকার পানি নিষ্কাশনের একমাত্র অবলম্বন মান্ডা খালের উৎপত্তি সেগুনবাগিচা থেকে। খালটি সেগুনবাগিচা, বিজয়নগর, ফকিরাপুল, আরামবাগ, কমলাপুর, মতিঝিল, বাংলাদেশ ব্যাংক, টিটিপাড়া, মুগদা, মানিকনগর, মান্ডা, নন্দীপাড়া ও ত্রিমুহনী হয়ে গুদারাঘাটে মিলিত হয়েছে।
 
বিশাল এ খালটির সেগুনবাগিচা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশে ঢাকা ওয়াসা বক্সকালবার্ড নির্মাণ করে। ফলে ঢাকা শহরের বড় খালগুলোর অন্যতম এ খালটি এখন আর দৃশ্যমান নেই। খালের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে বড় বড় রাস্তা ও স্থাপনা। অথচ এ খালটি ছিল ঢাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য অন্যতম অবলম্বন।

Manda
 
অপরদিকে মতিঝিল অংশ থেকে মান্ডা পর্যন্ত সড়কটি ১৫০ থেকে ১৭০ ফুট প্রস্থ ছিল। দখল হতে হতে খালের কোনো কোনো অংশ অস্তিত্ব হারিয়েছে। আবার কোনো কোনো অংশে ৬ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত দৃশ্যমান রয়েছে। এখন তাও দখলের পথে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মুগদা ও মানিকনগর ব্রিজটির দৈর্ঘ্য প্রায় দেড়শ ফুট। খালের প্রস্থ অনুপাতেই ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ এর পাশেই উঠে গেছে বহুতল ভবন। বর্তমানে বেদখলের কারণে মাত্র ৮ থেকে ১০ ফুট অংশ দিয়ে পানি প্রবাহ হচ্ছে।
 
দীর্ঘদিন ধরে খালটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করায় বিভিন্ন অংশে কচুরিপানা, শ্যাওলাসহ ময়লা-অবর্জনা জমে উর্বর হয়ে পড়ছে। পানিতে বাড়ছে দুর্গন্ধ। ফলে এলাকার পরিবেশ দূষণ হয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

Manda
 
পুরো খালের দুই অংশজুড়ে দখল করে গড়ে উঠেছে রিকশা গ্যারেজ। খালের মাঝখানেই বিভিন্ন ব্যক্তি নিজস্ব সম্পত্তি দাবি করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ খাম্বা স্থাপন করে মাটি ফেলে ভরাট করছেন। এছাড়া মসজিদ, মাদরাসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অংশে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন।
 
এতো দখলের পরও খালটির বর্তমান চিত্র থেকেও আশার আলো দেখছেন এলাকাবাসী। মুগদা-মানিকনগর ব্রিজ থেকে একটু সামনে গেলে চোখে পড়বে ছোট ছোট ডিঙি নৌকা। তবে পানি দূষিত হওয়ার কারণেই গন্ধে নৌকায় ছড়া যায় না। নাক চেপে এপার থেকে ওপার যেতে হয় এলাকাবাসীকে।
 
খালটির হারানো যৌবন শৈশবকালেই উপভোগ করেছেন মানিকনগরের বাসিন্ধা ইউসুফ আলী। এ খাল থেকে মাছ ধরেই চলতো তার সংসার। কিন্তু চোখের সামনেই দিন দিন খালটি হারিয়ে যাচ্ছে। দখলমুক্ত রাখতে তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা ঢাকা ওয়াসা কয়েক স্থানে কিছু উপদেশমূলক সাইনবোর্ড লাগিয়েই যেন দায় সারছে।

Manda
 
খাল নিয়ে ইউসূফ আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এক সময় আমাদের দাদা-দাদিরা এই খালের পানি দিয়েই সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ করতেন। ছোটকালে আমরা খালে মাছ ধরতাম, গোসল করতাম। খালের পানি খুব জোরেই প্রবাহিত হতো। শোঁ-শোঁ শব্দে ঘুম ভাঙতো। প্রখর রোদ পড়লে খালপাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম। এখন সেই খালে বহুতল ভবন।
 
তিনি অভিযোগ করে বলেন, সাধারণ মানুষ নয়, খাল বেদখলের জন্য দায়ী জেলা প্রশাসন। প্রশাসনের কর্মকর্তারা শুধু কিছু অর্থের বিনিময়ে খালের জমি ব্যক্তি বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে রেকর্ড করে দিয়েছে। সে সময় দায়িত্বে থাকা ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই অন্যরা সচেতন হয়ে যেতো।
 
সম্প্রতি দক্ষিণ নগর ভবনে খাল বিষয়ে এক বৈঠকে সরকারি খালের জমি ব্যক্তির নামে রেকর্ড হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। ওই বৈঠকে অংশ নেয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের কাছে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্ন ছিল এটা কীভাবে হলো? এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না।

তখন এর জবাব দিয়েছিলেন ওই বৈঠকে উপস্থিত মেয়র সাঈদ খোকন। তিনি বলেছিলেন, অতীতে কি হয়েছে সেসব বিষয় না দেখে আমরা সামনের দিকে এ গিয়ে যাই। যে টুকু আছে আমরা তা উদ্ধারে কাজ করি। ভবিষ্যতে যাতে আর এমন না হয়।

Manda
 
রাজধানীর মানিকনগর, সেগুনবাগিচা, বিজয়নগর, ফকিরাপুল, আরামবাগ, কমলাপুর, মতিঝিল, টিটিপাড়া, মুগদা, ঝিলপাড়, বালুরমাঠ ও মান্ডা এলাকার একমাত্র পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম মান্ডা খাল। এসব এলাকায় গৃহস্থালির ময়লা -আবর্জনাসহ নানা ধরনের বর্জ্য ফেলে খাল ভরাট করা হচ্ছে। খালটির কোনো কোনো অংশে পানি প্রবাহ থাকলেও নেই কর্তৃপক্ষের নজরদারি। স্থানীয়দের ফেলা ময়লায় দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে খালটি। কোথাও কোথাও উঠে গেছে বড় বড় স্থাপনা।
 
সরেজমিনে দেখা গেছে, মান্ড খালের দুই পাশ দখল করেই গড়ে উঠেছে শত শত দোকানপাট। এর মধ্যে চা, পান, মুদি, মোরগ, খাবার হোটেল, সবজি, রিকশা গ্যারেজ, ফল, মোবাইল, মাংস, ফার্নিচার, টেইলারসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে আবর্জনা সরাসরি খালে ফেলা হয়। এছাড়া খালের আশপাশের বাসা-বাড়ির স্যুয়ারেজ লাইনও রয়েছে এই খালের মধ্যে। আশপাশের বাসা-বাড়িতে যাওয়ার জন্য খালের ওপর গড়ে উঠেছে শত শত বাঁশের সাঁকো ও পোল কালভার্ট।
 
এদিকে প্রবাহ সচল রাখতে খালের তত্ত্বাবধানে থাকা ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্থানে শুধু উপদেশমূলক সাইনবোর্ড টাঙানো ছাড়া আর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না।
 
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, খালটির কিছু কিছু অংশ ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ড হয়ে গেছে। আমরা সেসব অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাব করেছি। তাছাড়া খাল উদ্ধারে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। অনুমোদন হলেই কাজ শুরু হবে।
 
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ রাজধানীর খাল বেদখল। এ খালগুলো উদ্ধার করা হলে জলাবদ্ধতা কমবে। আমরা এরই মধ্যে ঢাকা ওয়াসা, জেলা প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে বৈঠক করেছি। একটি খাল উদ্ধারে অভিযান করেছি। কেউ খাল দখল করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
 
এমএসএস/জেডএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।