আফতাবনগর-বনশ্রীর পেটে রামপুরা খাল


প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

দখল আর দূষণে হারিয়ে যাচ্ছে রাজধানীর খালগুলো। প্রবাহমান শতাধিক খালের মধ্য থেকে এখন এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬টিতে। দখলদারদের কবল থেকে রাজধানীর খালগুলো রক্ষা করতে একাধিক উদ্যোগ নেয়া হলেও সুফল আসেনি। ভূমিদস্যুদের বলয়গ্রাসে বিলীন হতে চলেছে নগরীর পানি নিষ্কাশনের এ মাধ্যমগুলো। ফলে বাড়ছে জলাবদ্ধতা। নেমে যাচ্ছে ভূপৃষ্ঠের পানির স্তর। নগরীর খালগুলো নিয়ে জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহেদ শফিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
Incert
ময়লার ডিপোতে পরিণত হয়েছে রাজধানীর রামপুরা খাল। আফতাবনগর আর বনশ্রীর বাসিন্দারা গিলে খাচ্ছেন ঐতিহ্যবাহী এ খালটি। এই দুই আবাসিক এলাকার বাসা-বাড়ির ময়লা থেকে শুরু করে ইমারত নির্মাণ-সামগ্রী ফেলেই খালটি ভরাট করা হচ্ছে। দূষিত ময়লা পানিতে পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও ব্যক্তিগত সম্পত্তি দাবি করে সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার কোথাও ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ-সংগঠনের ব্যানারে কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। ফলে দিন দিন প্রবাহ বন্ধ হয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে খালটি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রামপুরা খালের বনশ্রী অংশের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ গাড়ি ও বাসস্ট্যান্ড নির্মাণ করা হয়েছে। রামপুরা ব্রিজের উপরের বিশাল অংশ দখল করে বাংলাদেশ আওয়ামী মোটর চালক লীগের রামপুরা থানা কার্যালয় বানানো হয়েছে। এর পাশেই আবার নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে খোদেজা নার্গিস গংদের নামে খতিয়ান ও মৌজার নম্বর উল্লেখ করে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। এর পাশেই রয়েছে ঢাকা ওয়াসার একটি পাম্প ও ডিএনসিসির সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস)।
rampura
অন্যদিকে আফতাবনগর অংশে সীমানা দেয়াল পার হয়ে খালের মধ্যে মাটি ভরাট করে শাক-সবজির খেত তৈরি করেছেন খাল পাড়ের বাড়ির মালিকরা। কোথাও কোথাও ভবনও নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ফলে দিন দিন নাব্যতা হারিয়ে খালটি পরিণত হচ্ছে সরু ড্রেনে। ময়লা-আবর্জনা আর কচুরিপানার কারণে ভরাট হয়ে যাচ্ছে খালটি।

বনশ্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষে বাসাবাড়ি থেকে সংগ্রহ করা ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে এ খালে। সড়ক সম্প্রসারণের নামে খাল পাড় থেকে ৭ থেকে ১০ ফুট দখল করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। বনশ্রী বি-ব্লকসংলগ্ন স্বপ্নের সামনের বিশাল অংশ দখল করে বাসাবাড়ির বর্জ্য ফেলতে সিটি কর্পোরেশনের ডাস্টবিন রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও খোলা ল্যাট্রিনও নির্মাণ করা হয়েছে। আফতাবনগর-বনশ্রী যাতায়াতের জন্য খালের ওপর বাঁশ দিয়ে পুল নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বাঁশের গোড়ায় বর্জ্য জমে পানিপ্রবাহ বন্ধ হতে চলছে। খালের মেরাদিয়া বাজার অংশে কাঁচা মালামালের উচ্ছিষ্ট ফেলে ভরাট করা হচ্ছে।
Incert
মেরাদিয়া হাটের বিপরীতে খালের মধ্যেই রাখা হয়েছে ময়লা-আবর্জনার দুটি ডাস্টবিন। বনশ্রী, মেরাদিয়া, দক্ষিণ বনশ্রী, নন্দীপাড়াসহ আশপাশের বাসাবাড়ির বর্জ্য ফেলা হয় এখানে। এর পাশে মনপুরা কলেজ নামে একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়া হয়েছে খালের মধ্যেই। ফলে খালটির এ অংশ ভরাট হয়ে প্রবাহ বন্ধ হতে যাচ্ছে।

খালের পাশে বন্দর স্টিলের সৌজন্যে বনশ্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষে খাল ভরাট করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা- এমন ঘোষণা দিয়ে একাধিক সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। এরই মধ্যে খালের পাশের শতাধিক গাছ বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো এলাকা অস্থায়ী বাসস্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে। বাস-ট্রাক আর লেগুনার ধাক্কায় অন্তত দুই শতাধিক গাছ মৃত্যুর পথে।
rampura
স্থানীয়রা জানান, আশির দশকের শুরুর দিকেও রামপুরা খালের পশ্চিমাংশে কারওয়ানবাজার পর্যন্ত নৌপথ চালু ছিল। এক সময় এ খালটি দিয়ে হাতিরঝিল হয়ে নৌপথে শাক-সবজিসহ অন্যান্য মালামাল কারওয়ানবাজার যেতো। কারওয়ানবাজারে বিজিএমইএ ভবনের পাশে মাছের পাইকারি বাজারটিতে এক সময় শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদীর মাছের ল্যান্ডিং পোর্ট ছিল। এছাড়া খালটি মগবাজার, মধুবাগ, উলন, দাসপাড়া, রামপুরা, খিলগাঁও, মেরুল, বাড্ডা, বেগুনবাড়িসহ আশপাশ এলাকার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হতো। বর্তমানে হাতিরঝিল প্রকল্পের পানি পাম্পের মাধ্যমে এ খালের পানি নিষ্কাশন করা হয়। তাছাড়া ঝিলের অতিরিক্ত পানিও রামপুরা ব্রিজ হয়ে এ খালে পড়ে।
Incert
এক সময়ের ছোট নদীর আকৃতির খালটি দিন দিন ভরাট হলেও এর দায়িত্বে থাকা ঢাকা ওয়াসা বলছে, খালটি তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। সেজন্য তারা খালটির দায়িত্ব নিতে পারছেন না।

এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, সরকারি খাল-বিল যেন দখলদারদের ব্যক্তিগত সম্পদ। কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কারণে দখলদাররা উৎসাহিত হচ্ছে। রামপুরা খাল বন্ধ হলে ঢাকার পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এখনই সরকারের উচিত দ্রুত খালটি দখলমুক্তের ব্যবস্থা নেয়া।
rampura
বর্তমানে রাজধানীর বিশাল এলাকার গৃহস্থালি ও পয়ঃবর্জ্য এবং দূষিত পানি প্রবাহিত হচ্ছে রামপুরা খাল দিয়ে। বনশ্রীর কিছু অংশ, দক্ষিণ বনশ্রী, মেরাদিয়া, ভূঁইয়াপাড়া, মাদারটেক এবং এর আশপাশ এলাকা থেকে সংগ্রহ করা ময়লা রামপুরা খালের এ অংশে ফেলা হয়। নৌকায় আশপাশের এলাকা থেকে মেরাদিয়া হাটে ফলমূল ও শাকসবজি নিয়ে পাইকারি বিক্রেতারা আসেন। তারাও অনেক সময় অবিক্রীত তরিতরকারি খালেই ফেলেন। ফলে দুর্গন্ধের কারণে এ এলাকার বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।
Incert
এই বিষাক্ত পানিপ্রবাহ রামপুরা, বনশ্রী ও আফতাবনগরের প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। রামপুরা ব্রিজের নিচে দুটি স্টর্ম ড্রেন দিয়ে প্রতিনিয়ত দূষিত পানি এসে পড়ছে এ খালে। গৃহস্থালি ও স্যুয়ারেজ দুই ধরনের পানিই আসছে এ স্টর্ম ড্রেন দিয়ে। এর মধ্যে একটি স্টর্ম ড্রেন গুলশান-বাড্ডা-তেজগাঁও এলাকার, অন্যটি রামপুরা, মগবাজার ও কারওয়ানবাজার এলাকার। আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা পেতে সবসময়ই বাড়ির জানালা বন্ধ করে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন।
rampura
বনশ্রী জি-ব্লকের ২০ নম্বর বাড়ির মালিক হাজি সামসুল হক। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়িতে খালের পানির দুর্গন্ধে টেকা দায়। খালে বেশিরভাগ পচা শাকসবজি ফেলা হচ্ছে। দূষিত পানি ও পচা সবজি মিলে যে দুর্গন্ধ হয় তা সহ্য করার মতো না। রুম থেকে নাক চেপে বের হতে হয়। এ কারণে বাড়িতে ভাড়াটিয়াও থাকতে চায় না।’ এ বাড়ির মালিকের ভাষ্য, গত কয়েক বছর এ দূষণের পরিমাণ বেড়েছে।

এফ-ব্লকের বাসিন্দা আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, ‘চোখের সামনে একটি খাল দখলে-দূষণে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন তাদের নিজস্ব পরিবহনে ময়লা সরবরাহ করে না। কল্যাণ সমিতির লোকজন যে ময়লা ভ্যানগাড়ির মাধ্যমে নিয়ে যায়- এর বেশিরভাগই খালে ফেলা হয়। খাল রক্ষা করতে হলে দ্রুত সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা রাখতে হবে।’

এমএসএস/বিএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।