বেড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের আয়তন
ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের আয়তন। বদলে যাচ্ছে দেশের মানচিত্র। এভাবে বাড়তে বাড়তে একদিন অনেক বড় হবে বাংলাদেশ। তখন অতিরিক্ত জনসংখ্যা অভিশাপ না হয়ে হবে আশীর্বাদ। খাদ্যাভাবও থাকবে না। কারণ জমি বাড়ছে, খাদ্য উৎপাদনও হবে দ্বিগুণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণে বিশাল ভূ-ভাগ তলিয়ে যাবে। উদ্বাস্তু হবে দেশের কোটি কোটি মানুষ, এমন প্রচারণা যারা চালাচ্ছেন তারা ভুল প্রমাণিত হবেন।
বিজ্ঞানীদের মতে, বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশির তলদেশ হবে ‘প্রমিজড ট্রেজার অব দ্য ফিউচার’ বা ‘প্রতিশ্রুত ভবিষ্যৎ সম্পদভাণ্ডার’। বিজ্ঞানীদের এ ধারণার সত্যতা মিলছে। কারণ নোয়াখালীর হাতিয়া ও চরসুবর্ণ উপজেলার একশ বর্গকিলোমিটার জুড়ে আড়াই লাখ লোকের বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করেছে সরকার। বসবাস শুরু করেই এখানকার লোকজন সরকারের দেয়া জমিতে বিভিন্ন কৃষিপণ্যের উৎপাদনে বিপ্লব ঘটাচ্ছেন। বঙ্গোপসাগর প্রান্তে গত ৫০ বছরে যে এক হাজার বর্গকিলোমিটার চর জেগেছে, তাতে ২৫ লাখ বাড়তি লোকের বসতি স্থাপন সম্ভব হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন নদীর মোহনায় যে চর পড়েছে তা সুপরিকল্পিতভাবে সুরক্ষা ও উদ্ধার করা হলে অন্তত ১৫ হাজার কিলোমিটার ভূমি উদ্ধার করা সম্ভব হবে। যেসব এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে চর জেগে উঠছে সে এলাকায় ক্রসবাঁধ দিয়ে ভূমি উদ্ধার ও বনায়নের মাধ্যমে তা স্থায়ীকরণ সম্ভব হবে। নেদারল্যান্ডস এ পদ্ধতিতে বিপুল পরিমাণ জমি সাগরপ্রান্ত থেকে উদ্ধার করেছে। বাংলাদেশকেও তারা এ ব্যাপারে আর্থিক সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করছে।
চর ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্টের (সিডিএসপি-৪) ল্যান্ড সেটেলমেন্ট উপদেষ্টা মো. রেজাউল করিমকে প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, নতুন উপকূলীয় চরাঞ্চলে বসবাসরত গরিব জনগণের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য হ্রাস, উপকূলীয় চরাঞ্চল থেকে দরিদ্র ভূমিহীন জনগোষ্ঠীকে খাসজমি বন্দোবস্ত ও উপকূলীয় অধিবাসীদের নিরাপদ বসবাস স্থাপন এবং তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করাই হচ্ছে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যে।
তিনি বলেন, চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্প-৪ বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দারিদ্র্য বিমোচনমূলক ও সফল প্রকল্প।
চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্প-৪ (ভূমি অংশ) ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮০ সাল থেকে নেদারল্যান্ডস সরকারের সহায়তায় ভূমি উদ্ধার প্রকল্পের মাধ্যমে সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার ও চর উন্নয়নের কাজ শুরু হয়।
পরবর্তীতে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চল, বিশেষত নোয়াখালী জেলায় চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্প ১, ২, ৩ ও ৪ এর মাধ্যমে ১৯৯৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ব্যাপক চর উন্নয়ন ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় ভূমি বন্দোবস্তের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের ১ম, ২য় ও ৩য় পর্যায়ের আওতায় ১৯৯৪ থেকে ২০১০ মেয়াদে ১৬ বছরে সমুদ্র থেকে জেগে ওঠা ৩০ হাজার একর ভূমির সার্বিক উন্নয়ন সাধনপূর্বক ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২২ হাজার নদীভাঙা ভূমিহীন পরিবারকে কৃষি খাসজমি বন্দোবস্ত করে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
সমুদ্র থেকে জেগে ওঠা আরও ৪৫ হাজার একর খাসজমি ১৪ হাজার ভূমিহীন পরিবারকে বিতরণের লক্ষ্যে প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, কক্সবাজার থেকে ৩০ কিলোমিটার সাগরের মধ্যে জেগে উঠেছে শুধু চর আর চর। সেসব চরে বেড়ে উঠছে সুন্দরবনের আদলে নতুন বন। বেড়ে উঠছে নতুন পর্যটন এলাকা। সাগরে কিছু অংশ ভেঙে যাচ্ছে, আবার কিছু জমি জেগে উঠছে। ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠছে এ ‘প্যারাবন’। সুন্দরবনের মতোই এ বনের ভেতরে রয়েছে ছোট ছোট নদী। নদীর দুই পাশে জঙ্গল।
চর ডেভলপমেন্ট সংশ্লিষ্ট ও এনজিও কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জাগো নিউজকে জানান, এসব বন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ছাড়াও ভবিষ্যতে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এসব বন হতে পারে দেশের বনজ সম্পদের অন্যতম উৎস। সুন্দরবন থেকে যেসব কাঠ শিল্পে জোগান দেয়া হয়, সেসব কাঠ এখান থেকে ভবিষ্যতে সংগ্রহ করা যাবে। সুন্দরবন যেমন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করছে, তেমনই এ বনও দেশের পূর্বাঞ্চলকে ভবিষ্যতে রক্ষা করবে। হতে পারে পুষ্টি উৎপাদক, পানি শুদ্ধকারক, পলি সঞ্চয়কারী, ঝড় প্রতিরোধক, উপকূল স্থিতিকারী ও সম্পদের আধার। এমনকি হতে পারে নতুন পর্যটন কেন্দ্রও।
বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৬৫ সালের দিকে বন করার লক্ষ্যে এ অঞ্চলে প্রথম গাছ লাগানো হয়। শুরু হয়েছিল কেওড়া দিয়ে। সমুদ্রের পানিতে লবণ বেড়ে যাওয়ায় এখন কেওড়া গাছ আর বাড়ছে না। বেশি হচ্ছে বাইন। বন বিভাগ কিছু এলাকায় লাগিয়েছে গোলপাতা। গোলপাতা ভালোই বাড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া আছে ছইলা ও ঝাউ। রয়েছে কেয়াকাটা গাছ। মাত্র ৫০ বছরে একেবার নতুন বনাঞ্চল তৈরি হয়েছে এখানে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০০-২০০১ মেয়াদে এখানে বনের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার একর। বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বেশ কয়েক বছর আগে একটি ছোট চরের আড়াই একর জমিতে ৪ হাজার ৪৪৪টি গাছ লাগানো হয়েছিল। সেই চরের গাছের বীজ থেকে প্রাকৃতিকভাবে এখন হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার গাছ। এখানে আরও দুইশ একর জমিতে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করছে সরকারের বন বিভাগের।
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। গত সাড়ে চার দশকে বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে বসতবাড়ি, স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট, শিল্প কারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে কৃষিজমি ব্যবহার হওয়ায় জমির পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে। সাগর পাড়ে জেগে ওঠা জমি ব্যবহার করা সম্ভব হলে এ সঙ্কট অনেকটা মিটে যাবে।
এফএইচএস/ওআর/এমএস