যানজট নিরসনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থানান্তরসহ ১৮ দফা সুপারিশ


প্রকাশিত: ০৪:০৯ এএম, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭

যানজট রাজধানীবাসীর নিত্যসঙ্গী। এ যানজট নিরসনে সরকারের অনেক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ কাজে আসেনি। তবে এবার ঢাকা শহরের যানজট সমস্যার কারণ ও প্রতিকারের উপায় বের করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সোয়া দুই বছর অনুসন্ধান করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি কর্তৃক গঠিত তিন সদস্যের সাব কমিটি। চলতি মাসে প্রকাশ করা এ প্রতিবেদনে ভিআইপিদের যাতায়াত ব্যবস্থা ও গাড়ি পার্কিংয়ে নতুন আইনসহ ১৮ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। যাতে নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তনসহ অফিস, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থানান্তরেরও সুপারিশ রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে- ঢাকা শহরকে যানজটমুক্ত ও পরিবহন ব্যবস্থাকে গতিশীল করতে চলমান প্রকল্প বা যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন, এমআরটি-৬ মোট্রোরেল লাইনের মূল পরিকল্পনা কিছুটা পরিবর্তন করে মিরপুর-১০, আগারগাঁও ক্রসিং, বিজয় সরণি ক্রসিং, ফার্মগেট ক্রসিং, সোনাগাঁও ও বাংলামোটর ক্রসিং, শাহবাগ ক্রসিং, জিপিও ক্রসিং এ বর্ধিত চার লেনের যানবাহন পারাপারের ব্যবস্থা এবং ভবিষ্যতে নির্মিত লাইনেও এ ধরনের ব্যবস্থা সংযুক্ত করা।

ঢাকা শহরের আয়তন ও যানবাহন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রয়োজনীয় রাস্তা সম্প্রসারণ। পূর্বাচলের ৩শ ফুট রাস্তা হতে খিলগাঁও পর্যন্ত একটি বিকল্প রাস্তা নির্মাণ। মহাখালী এলাকার যানজট নিরসনের জন্য মহাখালী ফ্লাইওভারের সঙ্গে একটি লুপ নির্মাণ করে মহাখালী বাস টার্মিনাল অতিক্রম করা। রাজধানীর পাশে লিঙ্ক/বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা।

সব রাস্তার ক্রসিংমোড় এবং ইউটার্নগুলো যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে চিহ্নিত করা হয়েছে। এজন্য শ্যামলী, নতুনবাজার, রামপুরা-হাতিরঝিলের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে ডিএমপি ও অন্যান্য সংস্থা কর্তৃক ইউলুপ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।

মিরপুর রোড, বিমানবন্দর রোড, সাতরাস্তা রোড, প্রগতি সরণি, সাতমসজিদ রোডসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সকাল ৭টা থেকে ১০টা এবং বিকেল ৫ট থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাস বে পদ্ধতিতে চালানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এই সময় নির্ধারিত লেনগুলোতে বাস ছাড়া কোনো ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করতে পারবে না।

ডিটিসিএর প্রস্তাব অনুযায়ী একটি রুটে চলাচলকারী একাধিক কোম্পানির বাসের সমন্বয়ে একটি কোম্পানি অথবা কনসোর্টিয়াম করে একটি রুটে একটি কোম্পানির বা কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে বাস চালাতে হবে। পিপিপির মাধ্যমে গাবতলী, মহাখালী, সায়দাবাদ বাস টার্মিনালগুলোকে বহুতল বাস টার্মিনালে রূপান্তর করতে হবে। বাস টার্মিনাল এলাকার যানজট বন্ধে টার্মিনালের সামনের প্রধান সড়কের উপর দিয়ে গাড়ি পারাপারের জন্য ইউলুপ নির্মাণ করা।

janjot
অশিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালনা এবং বিত্তবান-ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের প্রাইভেট গাড়ি চালকদের আইন বর্হিভূত ও রাস্তার বিপরীত দিক দিয়ে গাড়ি চালানো বন্ধে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উদ্যোগে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে এতে ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৭দিন গাড়ি চালানোর আইনকানুন, শারীরিক ও মানসিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। অন্যান্য বিভাগীয় শহরেও একই ধরনের প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।

সুপারিশে আরও আছে- ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করতে আইন ভঙ্গকারীদের উচ্চহারে জরিমানা বৃদ্ধি করা। ভিআইপি এবং তাদের নাম বা গাড়ি ব্যবহারকারীদের গাড়ি কোনোভাবেই উল্টো পথে চলতে দেয়া হবে না। প্রাধিকার ছাড়া অন্য গাড়ির পতাকা, স্টিকার এবং ভিআইপি হর্ন খুলে ফেলতে হবে। ভিআইপিদের ব্যবহারের জন্য দুটি এবং মহানগরের বাইরে শুধু জেলা প্রশাসকের ১টি গাড়িতে পতাকা স্টান্ড রাখা যাবে।

যানজট নিরসনে ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করাসহ পরিবেশের ক্ষতি না করে মাটির নিচে পার্কিং নির্মাণ করা। বিশেষ করে মোহামেডান ক্লাব সংলগ্ন মাঠ খেলার জন্য উন্মুক্ত রেখে মাটির নিচে বহুতল পার্কিং নির্মাণ। একইভাবে জীবনবীমার সামনের রাস্তা ও পার্কের নিচে, গুলিস্থান পার্ক, ওসমানী উদ্যান, শাহবাগ মোড় থেকে টিএসসিমুখী রাস্তার নিচে, সাইন্সল্যাবের মাঠ, ঢাকা কলেজের মাঠ, নিউ মার্কেটের পিছনের কাঁচাবাজারের নিচ, লালমাটিয়া খেলার মাঠের নিচ, কারওরানবাজার ও তেজকুনিপাড়া কাঁচাবাজারের নিচ, সরকারি তিতুমীর কলেজের মাঠের নিচ, মহাখালী টিবি হাসপাতালের নিচ, গুলশান-১ এর ডিএনসিসি মার্কেটের নিচে, গুলশান-২ এর (সাবেক ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্কের ) নিচ, বনানীর একাধিক মাঠসহ রাজধানীর অন্যান্য জায়গার উপরের স্থাপনা ঠিক রেখে স্টাডিপূর্বক মাটির নিচে পার্কিং নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।

গুলশান, বনানী, মহাখালী এলাকার আবাসিক ভবন থেকে বিভিন্ন অফিস, রেস্তোরাঁ, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সরিয়ে নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। গুলশান, বনানী, মহাখালী এলাকার ব্যাণিজ্যিক অফিসগুলো বারিধারা থেকে জলসিঁড়িঁমুখী নতুন রাস্তা এবং পূর্বাচল ৩শ ফুট রাস্তার মধ্যবর্তী সুবিধাজনক স্থানে জমি অধিগ্রহণ করে বিশেষায়িত ব্যাণিজ্যিক ব্লক তৈরি করে স্থানান্তর। এছাড়া মাটিকাটা এলাকায় বাণিজ্যিক ব্লক তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে।

ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, লালমাটিয়া, উত্তরায় অবস্থিত বাংলা ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিং সেন্টার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যাতায়াতের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন। এসব শিক্ষার্থীদের জন্য দ্রুত বাসের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে কোনোভাবেই অতিরিক্ত ফি আদায় করা যাবে না। প্রয়োজনে সরকার কর্তৃক বিশেষ ব্যবস্থায় স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণ প্রদান করতে হবে।

সুপারিশে ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে বলা হয়- ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পুলিশ সার্জেন্ট ও ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি। নিয়োগ না দেয়া পর্যন্ত পুলিশ লাইন থেকে জনবল নিয়োগ। পথচারীদের সর্বাধিক ব্যবহৃত স্থান বিবেচনা এবং ভবিষ্যত উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয়ে বিস্তারিত স্টাডি করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে চলন্ত সিঁড়িসহ ফুট ওভারব্রিজ/আন্ডারপাস নির্মাণ এবং জনগণকে ব্যবহারে বাধ্য করা। রাজধানীর উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনাকারী (সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, বিটিসিএল, ডেসকো) প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
 
janjot
পুরাতন লক্কর ঝক্কর গাড়ি রাস্তা থেকে তুলে দিয়ে নতুন পাবলিক বাস চালু করা। ফুটপাত দখলমুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট এলাকার এমপি, সরকারি কর্মকর্তা ও কাউন্সিলরদের সঙ্গে সমন্বয় করে কমিটি গঠন। একই মন্ত্রণালয়ের দফতর, অধিদফতর, পরিদফতর দূরবর্তী একাধিক জায়গায় না রেখে সুবিধাজনক স্থানে একত্রে রাখা।

জানা গেছে- ‘ঢাকা শহরের যানজট সমস্যার কারণ ও প্রতিকারের উপায় অনুসন্ধান’ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট ৩ সদস্যের একটি সাব কমিটি গঠন করে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপিকে। অপর দুই সদস্য হলেন- গাইবান্ধা-৪ আসনের এমপি আবুল কালাম আজাদ ও ময়মনসিংহ-৮ আসনের এমপি ফখরুল ইমাম।

সাব কমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি),  ট্রাফিক পুলিশ, বিআরটিএ, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, ডিপিডিসি, এলজিইডি, রাজউক, জেকে কোম্পানি, ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রতিবেদনটি তৈরি করে।

ওই প্রতিবেদনে আরও সুপারিশ করা হয়-স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনপূর্বক ট্রাইল অ্যান্ড ইরোর কার্যক্রম পরিচালনা। এ কমিটিতে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনকে অন্তর্ভুক্ত করা।

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. ফারুক জলিল বলেন, রাজধানীর যানজট কমাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশগুলো আমরা পেয়েছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে তা বাস্তবায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। রাজধানীর যানজট নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে এমন বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এটিও তার মধ্যে একটি কর্মযজ্ঞ বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এসএইচএম/জেডএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।