মিষ্টি নিয়ে খেলা দেখতে বসছি : তসলিমা নাসরিন
ক্রিকেট আমার প্রিয় খেলা। ছোটবেলায় বাড়ির মাঠে ক্রিকেট খেলতাম। ঘরে বানানো ব্যাট বল দিয়ে। দাদাদের সত্যিকার ব্যাট বল ছিল। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করায় বাবা ওদের ব্যাট বল কিনে দিয়েছিলেন। আমি বা আমার বোন ভালো রেজাল্ট করার পর কিন্তু আমাদের ব্যাট বল জোটেনি। আমরা মেয়ে বলেই জোটেনি। পুরুষদের মধ্যে গভীর এক বিশ্বাস কাজ করে, মেয়েরা অংক বোঝে না, টাকা পয়সা বোঝে না, খেলা বোঝে না, ক্রিকেট তো বোঝেই না। দাদারা লক্ষ্য করতাম স্টেডিয়ামে যেতো ছেলে বন্ধু বা আত্মীয় নিয়ে। বাড়ির টিভির সামনেও বসে যেতো খেলা দেখতে, সেও ছেলেপুলেদের নিয়ে। আমাদের ডাকতো না। আমাদের সঙ্গে খেলা নিয়ে কথাও বলতো না। ওদের এই বদস্বভাবটা আজও যায়নি। ছোটবেলা থেকেই খেলা না বোঝার অপবাদটা এত শুনতে হয়েছে যে, ধীরে ধীরে নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম। মনে হতো, ঠিকই হয়তো আমরা মেয়েরা খেলা বুঝি না। খানিকটা বড় হওয়ার পর, ছেলেরা যখন হৈ চৈ করে খেলা দেখে, আমি তখন অন্য ঘরে বসে নীরবে বই পড়ি। খেলাটা জানতে হলে চেঁচানোর দরকার হয় না। ইউরোপে থাকাকালীন অনেক ইউরোপিয়ান বন্ধুদের ক্রিকেট খেলা শেখাতে চেয়েছি। ওরা রাগবি বোঝে, ফুটবল বোঝে, ক্রিকেট বোঝে না। ক্রিকেটের নামও অনেকে শোনেনি। কিছু ইউরোপিয়ান বন্ধু তো ইউটিউবে ক্রিকেট খেলা দেখে হেসেই অস্থির, বলে `এ কেমন অদ্ভুত খেলা, মাত্র তিনটে লোক খেলছে, বাকিরা কেউ খেলছে না, মাঠে দাঁড়িয়ে আছে।` কিছুদিন চেষ্টা করে বুঝে গেছি ওদের মাথায় ক্রিকেট ঢুকবে না। হাল ছেড়ে দিয়েছি।
বিশ্বকাপের খেলা দেখছি, বিশেষ করে ভারত আর বাংলাদেশ যখন খেলছে। ভারত জিতছে আর কিলো কিলো মিষ্টি কিনে পড়শিদের খাওয়াচ্ছি। বাংলাদেশ জিতছে, একইভাবে মিষ্টি বিতরণ চলছে। রসগোল্লা, সন্দেশ, ছানার জিলিপি, রাজভোগ, রসমালাই, চন্দ্রপুলি, মধুক্ষরা...। অনেকেই জিজ্ঞেস করছে, উনিশ তারিখে ভারত-বাংলাদেশ খেলায় আমি কোন পক্ষ নেবো? আমি কোনও দলের পক্ষে অন্ধের মতো চেঁচানোর বদলে খেলাটা উপভোগ করতে পছন্দ করি। নিউজিল্যান্ড আর বাংলাদেশের খেলাটা খেলা হিসেবে বেশ ভালো ছিল, যদিও বাংলাদেশ হেরেছে। শ্রীলংকা আর বাংলাদেশের খেলা খেলা হিসেবে, আমার মনে হয়নি, ভালো কোনও খেলা। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ভারতের খেলাটা বেশ চমৎকার। কী করে প্রায় হেরে যেতে যেতে জিতে গেছে ভারত, দেখার মতো। এখন অপেক্ষা করে আছি ভারত আর বাংলাদেশের খেলা দেখতে। ভারত-পাকিস্তান খেলা মানে ভীষণই উত্তেজনা, অন্য কোথাও না হলেও এই উপমহাদেশে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আরো একটি দেশ যোগ দিয়েছে উত্তেজনার খেলায়, সে বাংলাদেশ।
ভারত-বাংলাদেশের খেলা নিয়ে `মওকা মওকা` বলে একটা ভিডিও বানিয়েছে ভারত, ওতে লেখা `ইন্ডিয়া ক্রিয়েটেড বাংলাদেশ`। তা দেখে বাংলাদেশের লোকেরা খচে লাট্টু হয়ে আছে। তারা মোটেও বিশ্বাস করেনা ভারত বাংলাদেশকে জন্ম দিয়েছে বা নির্মাণ করেছে। তারা মনে করে, একাত্তরের যুদ্ধটা হয়েছিল বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মধ্যে, যুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে ভারত, এই যা। এদিকে ভারতের কেউ কেউ বিশ্বাস করে, যুদ্ধটা ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ, পাকিস্তানকে হারিয়েছে ভারত, হারিয়ে নতুন একটা দেশ তৈরি করেছে, বাংলাদেশ নাম। যদিও ভারতের সাহায্য ছাড়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ে বাংলাদেশের জেতার কোনও সম্ভাবনা ছিল না, তারপরও বাংলাদেশের মানুষ অহংকার করে বলে, `মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছে`।
তারা মনে করে যুদ্ধটা মূলত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা আর পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধটা কিন্তু একটা বিশাল গৌরবের ব্যাপার। এ, সত্যি বলতে কী, তাদের এক ধরনের আইডেনটিটি। তারা জানে, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি পাকিস্তানপন্থী ইসলামি-মৌলবাদী গোষ্ঠী ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে, এ সময় নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, আর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে রাখতে হবে। উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার শাসক আর নেই বটে, তবে ঘরের শত্রু বিভীষণের অভাব নেই। ধর্মের নামে ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিতে দেশ ছেয়ে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে।
ভারতের `মওকা মওকা` ভিডিওর প্রচুর পাল্টা-ভিডিও বানিয়েছে বাংলাদেশের ছেলেপুলেরা। তারা বোঝাতে চাইছে উনিশ তারিখের খেলায় ভারতকে হারিয়ে দেবে বাংলাদেশ, ঠিক যেভাবে ২০০৭ সালে হারিয়েছিল। এবার বাংলাদেশ ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ থেকে বিদেয় করে মনে জোর পেয়েছে, টপ ফেভারিট নিউজিল্যান্ডকেও ঘাম ছুটিয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা আছে তার। তাই বলে বেড়াচ্ছে, ভারতকে তারা এবার হারাবেই হারাবে, ঠিক ২০০৭এর মতো অবস্থা করে ছাড়বে। আট বছর আগে ঘি খেয়েছিল, এখনও আঙুলে তুড়ি বাজে না। আট বছর আগে জিতেছিল, এখনও সেই এক স্মৃতি নিয়েই হম্বিতম্বি। অভিনেতা প্রসেনজিৎ বাঘ আর বেড়ালের পার্থক্য বোঝাতে গেছে, অমনি বাংলাদেশের ছেলেরা রেগে আগুন, তারা নাকি বাঘ, কোনোভাবেই বেড়াল নয়। প্রসেনজিৎকে শেষ অবধি ক্ষমা চাইতে হয়েছে। ধোনী বা সিধু কী বললো, অমনি তাদের কুশপুতুল পোড়ানো হয়ে গেল। এদিকে শুনছি শশি থারুরের `ধন্যবাদ বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ভারতের বিশ্বকাপ সেমি ফাইনালে ওঠার রাস্তা সহজ করে দিলে তোমরা।` টুইটের পর তাঁর ওয়েবসাইট হ্যাক করে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের হ্যাকার গ্রুপ `ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার্স`। এই হ্যাকার্সরা নাকি আরও ভারতীয়দের ওয়েব সাইট হ্যাক করছে, বিশেষ করে যে সাইটগুলোয় মওকা মওকা ভিডিওটি আছে। বেশ বাড়াবাড়িই করছে বাংলাদেশের ক্রেজি দেশপ্রেমিকরা।
ক্রিকেটের জগতে ভারত হলো বাংলাদেশের দাদা। দাদাগিরিটা ভারত কিন্তু করতে ভুলছে না। চুনোপুঁটির কাণ্ড দেখে হাঙ্গর যেমন হাসে, তেমনই হাসছে। ভারতের যাকেই জিজ্ঞেস করছি, `কে জিতবে, ভারত নাকি বাংলাদেশ?` তুমুল হেসে বলছে, `অবশ্যই ভারত`। ভারত জিতবে এ নিয়ে ভারতের কারোর একবিন্দু সন্দেহ নেই। কেউ কেউ কৌতুক করে বলছে, `সেদিনকার বাচ্চা খেলোয়াড়রা এসেছে কিনা বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ভারতকে চ্যালেঞ্জ করতে! স্পর্ধা দেখে বাঁচি না`। সেদিন বাংলাদেশ আর নিউজিল্যান্ডের খেলায় দেখলাম ভারতের অনেকে নিউজিল্যান্ডকে সমর্থন করছে। পাশের দেশকে না করে দূরের দেশকে কেন সমর্থন করছো জিজ্ঞেস করায় কিছু ভারতীয় হাবিজাবি সব যুক্তি দেখালো। পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই লক্ষ করছি বাংলাদেশের পক্ষে। তারা বলছেও, `এগারোজন বাঙালি খেলছে, খুব গর্ব হচ্ছে বাঙালি হিসেবে!` কলকাতার কিছু বাঙালি তো পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট কথা জোরেশোরেই বলছে, ভারত আর বাংলাদেশের খেলায় তারা বাংলাদেশের পক্ষে; কারণ তারা প্রথমে বাঙালি, পরে ভারতীয়।
আমি ভালো খেলা এনজয় করি। আর, আন্ডারডগকে সাপোর্ট করার একটা বাতিক আছে আমার। এই বাতিকের কারণেই ভারত আর বাংলাদেশের খেলায় বাংলাদেশকে সাপোর্ট করবো, কিন্তু ভারত যদি ভীষণ ভালো খেলে, ভারতের জেতায় খুশি হবো না, তা কি হয়? আন্ডারডগ হয়েছে বলে জঘন্য খেললেও তালি বাজাবো, তা পারবো না।
উনিশ তারিখ রীতিমত উৎসব করে খেলা দেখবো। আমার বাড়িটাকেই একটা ছোটখাটো স্টেডিয়াম বানিয়ে ফেলবো। টুইটারে অলরেডি জানিয়ে দিয়েছি আমার প্ল্যান। প্রচুর মিষ্টি কিনবো। আমার সঙ্গে বেশ ক`জন ভারতীয় ক্রিকেটপাগল খেলা দেখবে। কথা হয়ে গেছে ওদের সঙ্গেও, বাংলাদেশ একটা উইকেট নেবে, মিষ্টি। ভারত ছক্কা মারবে, মিষ্টি। এইভাবে মিষ্টি খেতে খেতে খেলা দেখা হবে। তারপর, সমাপ্তিতে যে দলই জিতুক, ভারত বা বাংলাদেশ, ননস্টপ মিষ্টি খাওয়া চলবে। প্ল্যানটা, এদিককার সকলে বলেছে, মন্দ নয়।
কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে, বাংলাদেশে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, আমি কেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত জিতলে খুশি হবো বা মিষ্টি খাওয়াবো মানুষকে। ভারতে থাকি বলে কি ভারতের প্রতি পক্ষপাত? আমার কিন্তু মনে হয় না। ভারতের টিম আমার `অল টাইম ফেভারিট` টিম। বাংলাদেশ নতুন দল। দলটিকে এখনও অনেক খেলা খেলতে হবে আরও ভালো খেলা খেলতে হলে। বাংলাদেশ জিতলে খুশি তো হবোই, আর ভারত জিতলে, ফেভারিট টিম জিতলে, অখুশি হওয়ার কোনও কারণ নেই, খুশিই হবো। সম্ভবত আমি জাতীয়তা-সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে ওঠা মানুষ, সে কারণেই বাংলাদেশ আর শ্রীলংকা যখন খেলছিল, শ্রীলংকা ভালো খেলছিল বলে চাইছিলাম শ্রীলংকাই ভালো খেলার পুরস্কার পাক, জিতুক।
একেবারে নিরপক্ষ হয়ে খেলা দেখার মজাই আলাদা।
এসআরজে