সোহরাওয়ার্দীর কারণে যৌথ বাংলার আন্দোলন চাঙা হয়নি


প্রকাশিত: ০২:৪৭ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬

আফসান চৌধুরী। সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক। জন্ম ১৯৫৪ সালে ঢাকায়। সাংবাদিকতা জীবনে ঢাকা কুরিয়ার, দ্য ডেইলি স্টার ও বিবিসিতে কাজ করেছেন। হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র প্রকল্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। গবেষণাধর্মী কাজের পাশাপাশি সৃজনশীল সাহিত্যেও রয়েছে তার উল্লেখযোগ্য অবদান। বর্তমানে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। ধারাবাহিক চার পর্বের আজ থাকছে প্রথম পর্ব

জাগো নিউজ : মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করছেন। মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস প্রসঙ্গে যদি কিছু বলতেন।  
আফসান চৌধুরী : মুক্তিযুদ্ধকে বুঝতে হলে পেছনের ইতিহাস জানতে হবে। ৯ মাস যুদ্ধের ঘটনা প্রবাহ থেকে গোটা বিষয়কে পরিষ্কার বুঝবে না। এর একটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল খুবই দুর্বল। মূলত ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে আসার পর থেকেই কৃষকরা রাজনৈতিক ব্যক্তি হতে থাকে। এখানকার মানুষের প্রধান পরিচয় ছিল তারা কৃষক। দ্বিতীয় পরিচয় কেউ হিন্দু কৃষক, কেউ মুসলমান কৃষক।

ব্রিটিশদের সময় এই অঞ্চলে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। এটিকে কৃষকের বিদ্রোহও বলা যায়। ফকিররা সামনে ছিলেন কিন্তু কৃষকরা পেছনে থেকে প্রধান শক্তি জুগিয়েছেন। ইংরেজরা আসার পর কৃষকদের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন শুরু হলো। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে প্রায় এক কোটি বাঙালি কৃষক এবং সাধারণ মানুষ মারা গেল।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যু নিয়ে অনেক আবেগ ও ইতিহাস। এটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বিদেশি। তার মৃত্যুতে এমন কী হয়েছে? আমার কাছে আবেগের বিষয় কৃষকের ওপর নির্যাতন।

জাগো নিউজ : এই যে কৃষকের রাজনৈতিক হয়ে ওঠার ইতিহাস, এই সময় তো বাঙালির মধ্যে শ্রেণি বিভাজনটাও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
আফসান চৌধুরী : বিভাজন আগেই ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা আসার পর দালাল শ্রেণি গড়ে উঠল। কলকাতাভিত্তিক বাঙালির এক শ্রেণি নিজের স্বার্থে ব্রিটিশদের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায়রা অাফিমের ব্যবসায় জড়িয়ে ব্রিটিশদের দালালি করতে থাকেন। রাজা রামমোহন রায় ইংরেজদের বেতনভুক্ত ছিলেন এবং ইংরেজদের জন্যই সারাজীবন কাজ করে গেছেন। তারাই মূলত কলকাতাভিত্তিক মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি গড়েন। ব্রিটিশরাও তাদের সমর্থন দিতে থাকল।

এই সময় সুদের ব্যবসাটাও জমজমাট হলো। এটি একটি শ্রেণির সুবিধা পাওয়ার মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত হওয়ার ইতিহাস তৈরি করল। অপরদিকে কৃষকের ভাগ্যের কোনোই পরিবর্তন হয়নি। কথাগুলো বলছি এই কারণে যে, বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের এই ধাপটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

chowdhury

জমিদারি প্রথা প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেল বাঙালি হিন্দু কৃষকের পক্ষে কেউ দাঁড়ানোর ছিল না। ক্ষুদ্র পরিসরে, যেমন ১৭৮৩ সালে রংপুরে একজন ভাণ্ডামির নেতৃত্বে বিদ্রোহ হলো। এমন বিদ্রোহ অনেক হয়েছে। কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তনে কোনো কাজে দিলো না। টাকার মালিকরা জমিদারি কিনতে শুরু করল। এ জমিদাররা কিন্তু রাজনীতি এবং ব্রিটিশদের বিরোধিতা করা থেকে সরে আসতে লাগল। তখন মুসলমান কৃষকদের ছোট ছোট অংশ বিরোধিতা করতে শুরু করল। পরে কৃষকের বিদ্রোহই হয়ে গেল মুসলমানদের বিদ্রোহ।  

জাগো নিউজ : এই সময়টি তো কৃষকের জন্য ছিল বড় পরিবর্তন?
আফসান চৌধুরী : হ্যাঁ, এর মধ্য দিয়ে সমাজে দ্বিতীয় একটি ধারা তৈরি হলো। ১৮৫৭ সালের কথা। ভারতে যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন হচ্ছে, তখন কিন্তু বাংলায় কোনো আন্দোলন হয়নি। চারটি জায়গায় আন্দোলনের খবর মেলে। বাংলায় তখন ইংরেজপন্থীদের উত্থান। কেরানীগঞ্জ, জলপাইগুড়ি, ত্রিপুরা এবং শেরপুরের এই চারটি বিদ্রোহ ছাড়া বাংলায় আর কোনো বিদ্রোহের কথা আলোচনায় আসে না। কিন্তু এই চারটি বিদ্রোহ নিয়েও কোনো গবেষণা নেই।

একদিকে ওহাবি আন্দোলন অপরদিকে আদিবাসীদের। আদিবাসীরা সবসময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। তারা কখনই ব্রিটিশ শাসন মেনে নেয়নি। ব্রিটিশ শাসনে কলকাতাভিত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির লাভ হয়েছিল বলেই তারা মেনে নিয়েছিল। ১৮৫৭ সালের পর ইংরেজরা মুসলমানদের সমর্থন দিয়ে হিন্দুদের বিপক্ষে আরেকটি জনগোষ্ঠী তৈরি করতে শুরু করল। যার ধারা তৈরি হলো আলীগড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আরেকটি নতুন মধ্যবিত্তের সৃষ্টি হতে থাকল।

স্যার সৈয়দ আহমেদ খান এবং রাজা রামমোহন রায় এই দুই দালালই কিন্তু পাকিস্তানপন্থী এবং ভারতপন্থী ধারার রাজনীতি সৃষ্টি করেছে। এই দুইজন ইংরেজদের সরাসরি পয়সা খাওয়া দালাল ছিল। এই বিভাজন একটি মৌলিক সময় পার করল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে।

১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলে রাজনীতি তৈরি হতে থাকল। সর্বভারতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ এই সময়ের রাজনীতিকে ঘিরেই প্রতিষ্ঠা পাওয়া। এই সময়ে হিন্দু বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাব বেড়ে যায়। এটি কোনো সাম্প্রদায়িকতা বলে মনে করি না। কারণ কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালিরা ছিল হিন্দু। সমাজে তাদের প্রভাব তো থাকবেই।

কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে যাওয়ার পরেই হিন্দু-মুসলমান বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি হতে থাকল। আর এই বৈরিতাই রাজনীতির কেন্দ্রে জায়গা করে নিল। এই রাজনীতির কবলে পড়েই ১৯৪৭ সালের জন্ম। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশ্বাসহীনতার রাজনীতির কারণে যৌথ বাংলার আন্দোলন চাঙা হলো না। জন্ম হলো পাকিস্তানের। আবুল হাশেমের বইয়ে তাই লেখা আছে। আমরা হলাম নিমরাজি পাকিস্তানি। অর্থাৎ বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে হলো।

chowdhury

জাগো নিউজ : নতুন মধ্যবিত্তের সৃষ্ট হলো, বলছিলেন। এ সময় পাকিস্তান প্রশ্নে কৃষকের চাওয়া কেমন দেখলেন?  
আফসান চৌধুরী : এখানকার কৃষকরা ২০০ বছর থেকে বলে আসছে, আমাকে খাইতে দাও। তারা কোনোদিনই এমন রাজনীতি চায়নি। কৃষক তো পেটের রাজনীতির বাইরে কিছু বুঝতে পারেনি। মধ্যবিত্তরা রাজনীতি করতে গিয়ে কৃষককে ব্যবহার করেছে মাত্র। ’৪৭-এর মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী লীগের জন্ম নেয়া ছিল আমাদের জন্য বড় একটি ঘটনা। রাজনীতির নেতৃত্ব পূর্ববঙ্গে চলে এলো। সোহরাওয়ার্দীসহ যারা মুসলিম লীগের নেতৃত্ব দিতেন, তাদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের যোগাযোগ খুব বেশি ছিল, তা বলা যাবে না। ’৪৭-এর পর তরুণরা একটি ‘ইনার গ্রুপ’ তৈরি করল। তারাই ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে, তাও বলা যাবে না। তবে তারাই প্রথম বলল, স্বাধীন দেশ চাই। এদেরই একজন মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরী। আমরা অনেকেই তার ব্যাপারে জানি না। তিনিই প্রথম স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। তিনি সিলেটের মানুষ।

মুসলিম লীগের সঙ্গে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের অনেক দ্বন্দ্ব ছিল। হারুণ সাহেবের বইয়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আছে। এসবই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি। অর্থাৎ মধ্যবিত্তের সুবিধা একটু সম্প্রসারিত হবে এবং কৃষকেরা একটু ভালো থাকবেন। আমাদের রাজনীতি তো এর বাইরে না।

জাগো নিউজ : বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাবি এই সময়ই তো তীব্র হলো...
আফসান চৌধুরী : না থাকলে ভাষার জন্য ১৯৪৮ সালে হরতাল হয় কীভাবে? ১৯৪৬ সালে ভোট দিয়েছে পাকিস্তানের জন্য। আবার ১৯৪৯ সালেই হিন্দু-মুসলিম যৌথভাবে জাতিসত্তার প্রশ্নে আন্দোলন করতে শুরু করল। তার মানে কি তিন বছরেই একটি সমাজের জাতিগত পরিচয় পাল্টে যায়? অবশ্যই না। ইংরেজরা শত্রু হলো। এরপর শত্রু হলো কংগ্রেস। ’৪৭-এর পর এসে দাবি পাকিস্তানের সঙ্গে বসবাস নয়। এ কারণে প্রেক্ষাপট টানতে হলে অনেক পেছনে যেতে হবে।

পাকিস্তানিরা অত্যাচার করেছে বলেই যে আমরা স্বাধীনতা চেয়েছি, ব্যাপারটা আসলে তা নয়। সুবিধাবঞ্চিত মানুষ মধ্যবিত্তের ওপর নির্ভর করে একটু ভালো থাকার চেষ্টা করে। আমাদের এখানেও তাই হয়েছে।

জাগো নিউজ : তার মানে মুক্তিযুদ্ধকে আপনি মধ্যবিত্তের আন্দোলনই বলতে চাইছেন?
আফসান চৌধুরী : শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, প্রতিটি আন্দোলনের নেতৃত্বেই মধ্যবিত্তরা থেকেছেন।এখানকার ইতিহাস তাই বলে। সামনে থাকে মধ্যবিত্তরাই। তবে তাদের সৈন্যবাহিনী হয় গরিবরাই।

এএসএস/জেএইচ/এসএইচএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।