‘চিন্তা করো না মা, বেশি দেরি করবো না’
‘স্যুপ খাচ্ছি মা, খেয়েই চলে আসবো। বেশি দেরি করবো না, সাড়ে ৮টার মধ্যেই ফিরবো।’ নিখোঁজ হওয়ার আগে মায়ের সঙ্গে ফোনে শেষবারের মতো এই কথাটি বলেছিলেন সাফায়াত হোসেন। এরপর থেকেই তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
ঘটনাটি ১ ডিসেম্বরের। বনানী মসজিদে নামাজের জন্য বের হন সাফায়াত। এরপর আর বাড়ি ফেরেননি তিনি। তার সঙ্গে ওইদিন একই এলাকা থেকে আরো তিনজন নিখোঁজ হন।
জাগো নিউজকে সেদিনের বর্ণনা করছিলেন সাফায়াতের বাবা মো. আলী হোসেন। তিনি জানান, ‘পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে সাফায়াত নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ শেষ করতে পারেনি। সারাদিন বাড়িতেই থাকতো সে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো, বোনদের পড়া দেখিয়ে দিত।’
নিখোঁজের দিন বাড়িতেই মাগরিবের নামাজ আদায় করেন সাফায়েত। এরপর বোনকে কোচিং সেন্টার থেকে বাড়িতে দিয়ে সোয়া ৭টার দিকে এশার নামাজ আদায় করতে বনানী মসজিদে যান। সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাইন হোসেন খান (পাভেল)। পাভেলের সঙ্গে ক্লাস সেভেন থেকে বন্ধুত্ব সাফায়েতের। মসজিদ থেকে বের হয়েই নর্দান ক্যাফেতে যান সাফায়াত। সেখানেও ছিলেন পাভেল। প্রায়ই এই ক্যাফেতে স্যুপ ও কফি খেতেন পাভেল।
সাফায়াতের ছোট বোন একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থী। তার পরীক্ষা আসন্ন ছিল। নামাজ পরে বাড়ি ফিরে বোনকে পড়াশুনায় সাহায্য করার কথা ছিল সাফায়াতের। তবে ক্যাফেতে যাওয়ার কারণে তার ফিরতে দেরি হচ্ছিল। ৮টা বেজে যাওয়ায় তার মা রেহেনা হোসেন ফোন দিলেন সাফায়াতকে। সাফায়াত সাড়ে ৮টায় ফেরার কথা বলেছিলেন। তবে পৌনে ৯টা থেকেই তার ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল।
একইসঙ্গে ফোন বন্ধ পাওয়া যায় তার বন্ধু পাভেলের। চিন্তিত পাভেলের মা ফোন দেন সাফায়াতের মাকে। একসঙ্গে দুই বন্ধুর ফোন বন্ধ থাকায় উদ্বিগ্ন হয়ে পরে দুই পরিবার। রাতেই বনানী থানাসহ আশপাশের এলাকায় খোঁজ নেন সাফায়াতের বাবা ও পাভেলের পরিবার।
রাতে তাদের না পেয়ে ফজর নামাজের পর মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে যান তারা। সেখানকার এক কর্মকর্তা সাফায়াতের বাবাকে বলেন, থানায় জিডি না করে এভাবে কারো সন্ধান করা যায় না। জিডি করার পরামর্শ দেন তিনি। জিডি করতে বনানী থানায় গিয়ে দেখেন সাফায়াত, পাভেলের মতো আরো দুই শিক্ষার্থী এভাবে নিখোঁজ হয়েছেন। পরদিন ৪র্থ জনের পরিবারও নিখোঁজের জিডি করেছেন।
জিডি করার পর পুলিশের তদন্তে ক্যাফের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তারা চারজনই নর্দান ক্যাফেতে এক টেবিলে বসে একসঙ্গে খেয়েছেন এবং আড্ডা দিয়েছেন। এদের মধ্যে একজন কিছুক্ষণ পরপর উঠে টয়লেটের সামনে গিয়ে ফোনে কথা বলছিলেন এবং এসএমএস দিচ্ছিলেন।
তাদের মোবাইল ট্র্যাক করে দেখা যায়, বনানী মার্কেটের পাশেই একসঙ্গে চারজনের মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। সাফায়েত ও পাভেল ছাড়া বাকি দুজন হচ্ছেন মেহেদি হাওলাদার ও মো. সুজন। পাভেল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মেহেদি বরিশালের বিএম কলেজের ছাত্র। আর সুজন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে তথ্যপ্রযুক্তিতে কোর্স করে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন।
এই চারজন জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়েছেন নাকি অপহৃত হয়েছেন এ বিষয়ে তদন্ত করছে পুলিশ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুলিশ ও গোয়েন্দারা তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। উদ্ধারের পরই সবকিছু জানা যাবে।’
তবে সাফায়াতের চালচলনে জঙ্গিবাদ কিংবা অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেননি তার বাবা আলী হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ছেলের কোনো শত্রু ছিল না। তাকে অপহরণ করতে পারে এমন কাউকে আমরা সন্দেহও করছি না। সাফায়াত সারাদিন বাসায় থাকতো, নামাজ-কালাম পড়তো। আমরা তার সন্ধান চাই।’
নিখোঁজ চারজনের মধ্যে ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিলেন সাফায়াত। তবে তার ওয়ালে উগ্রপন্থী বিষয়ক তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।
নিখোঁজ মো. মেহেদী হাসানের পরিবারের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তার সন্ধানে উদ্বিগ্ন স্ত্রী, বাবা-মা। ছয়দিন ধরে বাড়ির সবার খাওয়া দাওয়া বন্ধ। নিখোঁজ হওয়ার দিন বিকেলেই শেষবারের মতো ফোনে কথা হয়েছিল স্ত্রী শারমিন আক্তার রিংকির সঙ্গে। রিংকি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিকেলে ফোন দিয়ে স্বাভাবিক কথা বার্তা বলেছিল। তার কোনো শত্রু ছিল না। আমরা তাকে নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন।’
তাদের সন্ধানের বিষয়ে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিএম ফরমান আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘তাদের উদ্ধারে পুলিশ কাজ করছে।’
এআর/জেডএ/পিআর