ধর্ষিতাদের আর্তনাদ শোনার কেউ নেই


প্রকাশিত: ০৩:২৭ পিএম, ৩০ নভেম্বর ২০১৬

জাতিসংঘের মতে, বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত এক জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গা। দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশ ছাড়ছেন তারা। দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে তাদের। হন্যে হয়ে এদিক-সেদিক ঘুরছেন একটু আশ্রয়ের আশায়। ঢুকে পড়ছেন পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশেও।

নির্যাতিত এই জাতিগোষ্ঠীর খবর জানাতে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ঘুরে বেড়াচ্ছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহেদ শফিক। তার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব

মাত্র কয়েক বছর আগে সুখের সংসার বেঁধেছেন আক্তারা। ছয় সন্তানের জননী তিনি। গোয়াল ভরা গরু, মাঠ ভরা সবজি  ও পুকুর ভরা মাছে সাজিয়েছেন সংসার। মাঠ ভরা ধানে এবার ভরবে গোলা। চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল পরিবারের সবার। কিন্তু সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। এক সকালেই ভেঙে চুরমার সব স্বপ্ন।

কিছু বুঝে উঠতে না উঠতেই স্বামীকে মুখ বেঁধে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে সৈন্যরা। সাড়ে চার বছরের কোলের শিশু ছায়েদুর রহমানকে কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় পানিতে। চার মেয়ের সামনেই পাশবিকভাবে ধর্ষণ করে তাকে। একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। এরপর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থানার রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জাম্বুন্না গ্রামের বাসিন্দা আক্তারার সাজানো সংসার দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।

কয়জন সেনা সদস্য তাকে ধর্ষণ করেছে সে কথা মুখে না বললেও লজ্জিতভাবে হাত উঠিয়ে যা জানালেন তাতে সংখ্যাটা ১০-১২ জনের কম নয়। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে রোমহর্ষক সে কাহিনী বর্ণনা করেন তিনি। জানালেন কোলের শিশুসন্তানদের বাঁচানোর করুণ কাহিনীও।

তিনি জানান, ১০-১২ জন সেনা সদস্যের একটি দল তাকে ধর্ষণের পর অজ্ঞান অবস্থায় রেখে চলে যায়। এ সময় তার চার মেয়ে ধান খেতে লুকিয়ে আত্মগোপন করে। কোলের শিশুকে পানিতে ফেলে হত্যা করা হয়। স্বামীর মুখে প্লাস্টার মেরে গাছের সঙ্গে বেঁধে পায়ে গুলি করে সেনাবাহিনী। সেনারা চলে যাওয়ার পর তার মেয়েরা এসে তাকে দেখতে পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে।

জ্ঞান ফিরতে না ফিরতেই আরেক বিপদ। নির্যাতন হাঁটতে পারছিলেন না তিনি। ঘর থেকে বের হয়েই দেখেন পুরো গ্রাম জ্বলছে। চারদিকে শুধু আগুন আর আগুন। এর মধ্যে ঘরের একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে একদল সেনাবাহিনী। বের হলেই গুলি কিংবা ফের ধর্ষণ।

আক্তারা জানান, সেদিন আকাশে তীব্র রোদ থাকলেও আগুনের ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায় মংডু থানার রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলো। রোহিঙ্গা মুসলমানদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে আকাশ। কিন্তু কে শোনে কার কান্না?

সেদিন সেনাদের হাত থেকে সন্তানদের রক্ষা করতে বাড়ির কোনে ল্যাট্রিনের জন্য করা গর্তে কন্যাসন্তান ইয়াসমিন (১২), জান্নাতারা (১০), কহিনুর (৮), সাবনাজ বিবি (৭) ও রোকেয়া বেগমকে (৩) রেখে কলাপাতায় ঢেকে পালিয়ে দেশ ছাড়েন তিনি। কোলের দেড় বছরের শিশু ইব্রাহীমকে নিয়ে দুদিন হাঁটার পর একজন জেলের নৌকায় নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে আসেন শ্বশুর বাড়ির এক আত্মীয়ের খোঁজে।

জানতে পারেন ওই আত্মীয় আছেন টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। বহু খোঁজাখুঁজির পর তার সন্ধান পেয়ে ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে গর্তে রাখা সন্তানদের আনতে আবার রাতের আঁধারে ফের নিজ দেশে ফেরেন এই ধর্ষিতা নারী।

চারদিন পর নিজ বাড়ি ফেরেন এই রোহিঙ্গা। দেখেন পুড়ে গেছে বসত ভিটা। ল্যাট্রিনের গর্তে রাখা সন্তানরা কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে থাকলেও তাদের অবস্থা শোচনীয়। চারদিন অনাহারে থাকায় পেটের পীড়ায় ভুগছে তারা।

বাংলাদেশের ওই আত্মীয়ের কাছ থেকে নেয়া ৮টি রুটি পলিথিন থেকে বের করে খেতে দেন সন্তানদের। প্রাণে বাঁচে পাঁচ সন্তানের চারজন। তবে এখনও ফিরে পাননি কোলের ছেলে ছায়েদুরকে।

শুধু আক্তারাই নন, একই কাহিনী বর্ণনা করেছেন উত্তর জাম্বুনিয়ার বাসিন্দা মোহছেনা বেগম। তিনি জানান, সেদিন (৯ নভেম্বর) সকালে একদল সেনা সদস্য এসে তার বাড়ির তিন সদস্যকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। কিছু বুঝে উঠতে না উঠতেই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে কোলের শিশুকে পানিতে ছুড়ে ফেলে দেয়।

এরপর নারীদের ধরে নিয়ে যায় ধান খেতে। দিনভর চলে ধর্ষণ। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে দেখতে পান আদরের সন্তান পড়ে আছে ধান খেতে।

মোহছেনা জানান, শুধু তাকে নয়, জ্ঞান ফেরার পর ধান খেতে এমন অন্তত ৫০ জন নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতন অবস্থায় তিনি দেখেছেন। যাদের পরনে কোনো বস্ত্র ছিল না। এদের কয়েকজনকে গুলি করে হত্যাও করা হয়। এ সময় তার বাড়ি থেকে স্বামী আব্দুস শুক্কুরকে ধরে নিয়ে যায় সেনারা। পরে খবর পান তাকেও হত্যা করা হয়েছে।

মোহছেনার ভাই ইলিয়াছ জানান, ওইদিন তাদের বংশের অন্তত ২৪ জন পুরুষকে গুলি ও গলা কেটে হত্যা করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এদের মধ্যে বাবা সৈয়দ আহাম্মদ, খাইয়ের আহাম্মদ, চাচা মৌলভী রবিউল্যাহ, একলাস উদ্দিন, চাচাতো ভাই লাল মিয়া, আবুল কালাম, সবুর উল্যাহকে একইদিন গলা কেটে হত্যা করা হয়।

এছাড়া আরও ১০ জনকে চোখ, মুখ ও হাত বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

শুধু এরাই নয়, দুদিন ধরে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে আক্তারা কিংবা মোহছেনার মতো আরও অনেকেরই এমন নির্যাতনের তথ্য পাওয়া গেছে। শত শত নারী মিয়ানমান সেনাবাহিনীর হাতে ধর্ষিত হয়ে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে। লোকলজ্জা কিংবা অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর ভয়ে কেউ কেউ স্বীকার করছেন আবার কেউ কেউ এসব নির্যাতনের কাহিনী লুকিয়ে রাখছেন। যারা বলছেন তাদের কণ্ঠে ছিল ভয়ঙ্কর সেসব ঘটনার বর্ণনা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৯ নভেম্বর থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের পর বর্ডার পার হয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশ এসেছে অন্তত ৩০ হাজারের বেশি মানুষ। এদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত টেকনাফের অনিবন্ধিত লেদা ক্যাম্পে এক হাজার ৫৮৩ জন আশ্রয় নিয়েছেন।

ক্যাম্পের সাম্প্রতিক হিসাব মতে, এতে রয়েছে ২১ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গা। বর্তমানে এর সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি বলে জানিয়েছেন ক্যাম্প সদস্যরা।

অন্যদিকে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে বর্তমানে ৩৫ হাজার ৫৬৫ জন রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। প্রতিদিন এসব ক্যাম্পে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আশা শত শত রোহিঙ্গা। বুধবারও এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে অন্তত সাত শতাধিক মানুষ। তবে নতুন আসা রোহিঙ্গারা নিবন্ধিত ক্যাম্পে আশ্রয় পাচ্ছে না। তারা অনিবন্ধিত ক্যাম্প কিংবা তার আশপাশের বিভিন্ন স্থানে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন।

জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হিসাব মতে, টেকনাফ ও উখিয়ার দুটি নিবন্ধিত শিবিরে আশ্রয় পাওয়া ৩৩ হাজার ১০০ রোহিঙ্গা রয়েছে।

তারা সংস্থাটি থেকে মাসিক নির্দিষ্ট ভাতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পয়নিষ্কাশন সুবিধা পান। কিন্তু অনিবন্ধিত ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা এসব সুযোগ সুবিধা পান না। কেউ তাদের সহযোগিতা দিতে চাইলেও সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মুখোমুখি হতে হয়। সেজন্য কেউ রোহিঙ্গাদের দান-অনুদানে এগিয়ে আসেন না বলে জানিয়েছে রোহিঙ্গারা।

এমএসএস/ওআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।