দায় বাংলাদেশের সুবিধা নেবে ভারত
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ। নির্বাহী সভাপতি-পিপিআরসি (পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার)। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। অর্থনীতি, উন্নয়ন, রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেন রামপাল ইস্যুতে। সঙ্গে ছিলেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। তিন পর্বের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষ পর্ব।
জাগো নিউজ : রাজনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতার কথা বলছিলেন আগের পর্বে। এমন প্রতিযোগিতার মধ্যে সামনের নির্বাচন নিয়ে কী বলবেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : ‘ম্যানেজ’ নির্বাচন করার বাস্তবতা রয়েই গেছে। বৈধতার ঘাটতি মাথায় নিয়েই সরকার উন্নয়ন তত্ত্ব বিলিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মতো সাহস সরকার দেখাতে পারবে কি না, তা একটি খোলা প্রশ্ন থেকে যেতে পারে।
যদিও সুশাসন, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যে জঙ্গিবাদের বিস্তার নিয়ে বিতর্ক আছে এবং পরবর্তীতে কী হতে পারে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই।
জাগো নিউজ : কিন্তু এত কিছুর পরেও মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : মানুষ মূলত শত বাধা-বিপত্তির মাঝেও দমতে চায় না। মানুষের সহজাত প্রবৃদ্ধিই হচ্ছে এগিয়ে যাওয়ার। সাধারণ মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে বলেই অনানুষ্ঠানিক খাত হচ্ছে ৮৫ শতাংশ। ফিলিপাইন এত বিশৃঙ্খলার মধ্যেও তো এগিয়ে গেছে। তাদেরও সমৃদ্ধি আছে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে গুণগত তুলনা করলে ফিলিপাইন অনেক দূরে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশের তুলনা চলে কম্বোডিয়ার সঙ্গে। বাংলাদেশে মানুষ অর্থনৈতিক সুবিধা নিতে এসে মালিক হয়ে যাচ্ছেন। ব্যাংক, বীমা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে যাচ্ছেন রাষ্ট্রের আশীর্বাদপুষ্ট কতিপয় মানুষ। সুবিধা থেকে মালিক হওয়ার প্রবণতা সমাজের জন্য সুখের নয়।
জাগো নিউজ : এত উন্নয়ন তত্ত্ব দিয়েও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না, বাইরের বিনিয়োগকারীরাও আসছেন না। সরকারের বৈধতার ঘাটতি থেকেই কি বিনিয়োগে এই স্থবিরতা?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২১ শতাংশে আটকে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এত নিশ্চয়তা, এত উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক মহলেরও সমর্থন রয়েছে, কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না কেন? এর কারণ হচ্ছে, ঝুঁকিগুলো সাময়িকভাবে ‘ম্যানেজ’ করা গেলেও আনুগত্যের চরম ঘাটতি রয়েছে। কখন কী হয়, এই অনিশ্চয়তা সবার মধ্যেই বিরাজ করছে। এ কারণেই মানুষ টাকা থাকার পরেও বিনিয়োগের জন্য বের করছে না।
জাগো নিউজ : সঙ্কট উত্তরণে সামাজিক শক্তিগুলোর ভূমিকাও নিষ্ক্রিয়।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : রাজনৈতিক কারণে সামাজিক শক্তিগুলো অতিমাত্রায় গৌণ হয়ে গেছে। একেবারেই অবনতি ঘটেছে এই শক্তির। সক্ষমতা বলতে তাদের কিছু আছে বলে আর মনে হয় না।
জাগোনিউজ : তাহলে কি থেমে যাওয়ার গল্পতেই থাকতে হচ্ছে আমাদের?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : না। মানুষ থেমে থাকে না। প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায় যাওয়ার কথা আর কোথায় যেতে পারলাম আমরা। ১৯৮০ সালে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনামের মাথাপিছু আয় আমাদের সমান ছিল। তারা যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, সেই গতি যদি আমাদের থাকতো, তাহলে ২০১৪ সালে আমাদের রিজার্ভ ১৩৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হতো। গবেষণার ভিত্তিতে এ কথা বলছি। এটি কোনো বায়বীয় তথ্য নয়।
আমরা না খেয়ে মারা যাচ্ছি, এটি আর এখন আলোচনার বিষয় নয়। আলোচনার বিষয় কোথায় যাওয়ার কথা ছিল আর কোথায় যেতে পারলাম আমরা।
উন্নয়ন হবেই। আপনাকে গুরুত্ব দিতে হবে উন্নয়নের গতিতে। আলোচনার সারবস্তু এখানেই। খুব দ্রুত এই দৃশ্য পাল্টে যাবে, তাও মনে করার কোনো কারণ নেই। আগামী নির্বাচনও ‘ম্যানেজ’ নির্বাচন হবে তার সমস্ত আয়োজনও বহাল রয়েছে।
জাগো নিউজ : উন্নয়নের প্রশ্নেই রামপাল বিতর্ক। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে কী বলবেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : উন্নয়নের নামে চাপিয়ে দেয়ার সরকারের যে নীতি, রামপালে তারই প্রতিফলন ঘটছে। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদরা প্রতিবাদ করছে তা নয়, এটি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলও সোচ্চার। এমনকি ভারতের পরিবেশবিদরাও এই প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন। এতো বিরোধিতা সত্ত্বেও এই প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে সরকারের একঘেয়েমি প্রকাশ।
জাগো নিউজ : এই প্রকল্প দিয়ে সরকারের জন্য ঝুঁকি বাড়ছে। কেন এই ঝুঁকি নেয়া বা একঘেয়েমির প্রকাশ?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : পাশের দেশের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার্থেই এমনটি হতে পারে বলে মনে করি। তারাও এক প্রকার জোর করেই এই প্রকল্পে গুরুত্ব দিচ্ছে। দায় বাংলাদেশের সুবিধা নেবে ভারত। অন্যদিকে সরকার কোনো ইস্যুতেই পিছু হটার নয়, এই মানসিকতা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই প্রতিবাদ, প্রতিরোধকে আমলে নিচ্ছে না।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব আছে। এই রকম প্রকল্পে বিরোধিতা আরও স্পষ্ট হয়। ভারত কেন এই ঝুঁকি নিচ্ছে?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতেই ভারতের এই ভূরাজনৈতিক কৌশল। মূলত বাংলাদেশকে এককভাবে গুরুত্ব দিয়ে এটি করছে না। ভারতের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েই আছে। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, কাশ্মীর তো তার প্রমাণ। চীনকে ঠেকানোর নীতি থেকেই এমন বল প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তবে আমি মনি করি, ভারত কিছুটা অপরিপক্ক এবং স্ববিরোধী নীতি অনুসরণ করছে।
জাগো নিউজ : এটি কি আসলে অপরিপক্ক নীতি, না কি পরিকল্পিত?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : ভারত পরিকল্পিতভাবে রামপাল প্রকল্পে এসেছে, কিন্তু এর ফলাফল নিয়ে ভারতের নীতিতে পরিপক্কতার অভাব রয়েছে।
জাগো নিউজ : ফলাফল তো সব সময় ভারতের অনুকূলেই থাকে। বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভে ভারতের আর কী আসে যায়?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : ক্ষোভ বৃদ্ধি পেলে কী হবে তা হয়তো গবেষণার বিষয়। কিন্তু এ নিয়ে বিস্তর কোনো তথ্য বা গবেষণা নেই। ঠিক জঙ্গিবাদ ইস্যুর মতোই। তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক স্পর্শকাতর।
এএসএস/এআরএস/এনএফ/এমএস