প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি আছে


প্রকাশিত: ০৬:০৪ এএম, ১১ নভেম্বর ২০১৬

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ। নির্বাহী সভাপতি-পিপিআরসি (পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার)। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। অর্থনীতি, উন্নয়ন, রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেন রামপাল ইস্যুতে। সঙ্গে ছিলেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। তিন পর্বের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।


জাগো নিউজ : প্রবৃদ্ধি অর্জনে রেকর্ড গড়লো বাংলাদেশ। এই প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে কী বলবেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : সরকারের ঘোষিত এই প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে। প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকার জোর করে বলছে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি অর্জনে বেসরকারি বিনিয়োগসহ অন্যান্য বিষয় কোথায়, তার কোনো হিসাব মেলানো যাচ্ছে না।

সরকার বলছে, পাবলিক বিনিয়োগ বেড়ে গেছে। এটি ঠিক না। বলতে পারেন সরকারের ব্যয় বেড়ে গেছে। এই ব্যয় বেড়েছে অযৌক্তিক প্রকল্পের কারণে। সুতরাং সুশাসনের ঘাটতি, গণতন্ত্রের অভাব এবং অযৌক্তিক প্রকল্প ব্যয় বিশ্লেষণ করেই আপনাকে উন্নয়নের বিষয়টি আলোচনা করতে হবে।

উন্নয়ন আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বৈষম্য। আমরা ঢাকা শহরের ওপর জরিপ করলাম। রাজধানীর মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ ৪০ শতাংশ আয় ভোগ করে। আর নিচের ৫৮ শতাংশ মানুষ ভোগ করছে মাত্র ২১ শতাংশ আয়। কর্মসংস্থানের ঘাটতি, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং বৈষম্য- এই তিনটি বিষয়ই তো উন্নয়নের মাপকাঠি।  তার মানে সত্যিকার উন্নয়নের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।

Zillur

জাগো নিউজ : তাহলে এই উন্নয়নে কোথায় যাচ্ছি আমরা?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : উন্নয়ন বিষয়টি বোঝার জন্য আরেকটি বিষয় আমলে নিতে হয় এবং তা হচ্ছে রাজনৈতিক সক্ষমতা। চাহিদার দৃষ্টিকোণ থেকে এমন ঘাটতি তৈরি হতেই পারে।

কিন্তু রাজনৈতিক সক্ষমতাটা এখানে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ রাজনৈতিক অঙ্গনে কার অবস্থান কোথায়? সরকার আছে, বিরোধী শক্তি আছে, দাতা সংস্থাগুলোর প্রভাব আছে এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর উপস্থিতি আছে। এই চারটি শক্তিকে একত্র করে দেখলে, এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা?

ক্ষমতাসীন দল অনেক বেশি রাজনৈতিক সক্ষমতা দেখিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় বৈধতার যে ঘাটতি, তা থেকে উত্তরণের জন্য জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। শেষ বিচারে কতটুকু সফল হবে সরকার, সেটা ভিন্ন বিষয়। দলীয় প্রয়োজনে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করার সক্ষমতা অর্জন করেছে, তা বলা যেতেই পারে। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার চেষ্টা, বিরোধীদের নিষ্ক্রিয় করে ফেলার চেষ্টায় বিশেষ সক্ষমতা। জাতীয় পার্টিকে তো আওয়ামী লীগ হজমই করে ফেলেছে।
অর্থাৎ এই সক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ওই ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করছে। এই ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা দুইভাবে করার চেষ্টা করছে। একটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ অন্যটি বৈদেশিকভাবে।
 
উন্নয়ন তত্ত্বকে বাড়িয়ে বলে অভ্যন্তরীণভাবে বিশেষ প্রপাগাণ্ডা সৃষ্টি করা। আরেকটি হচ্ছে বৈদেশিক অঙ্গনে বিশেষ অবস্থান তৈরি করা। সংশ্লিষ্ট দেশগুলো তো শুধু গণতন্ত্র নিয়েই থাকে না, তাদের কাছে উন্নয়ন অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং নিজেদের বলয়গুলো শক্তিশালী করার প্রতিযোগিতা আছে। এখানে আমাদের ক্ষমতাসীন দল এক ধরনের রাজনৈতিক সক্ষমতা দেখাতে পারছে বলে মনে করি।

যেমন দীপু মনিকে বাদ দিয়ে মাহমুদ আলীকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা ছিল এই সরকারের একটি স্মার্ট সিদ্ধান্ত। দীপু মনি চরম অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু মাহমুদ আলী খুব ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। ‘বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, গণতন্ত্রের কিছুটা ঘাটতি আছে, তা স্বীকার করছি কিন্তু আমরা তো উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতেই পারি। একটি ব্যবহারিক দরকষাকষির মধ্য দিয়ে সরকার বিদেশিদের সমর্থন আদায় করার চেষ্টা করছে। পুরোপুরি না পারলেও এক্ষেত্রে কিছুটা সফলও বটে। বিশেষ করে পাশের দেশ ভারতকে অতি কাছে পাওয়া সরকারের বিশেষ সফলতা হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে।

এই পরিস্থিতির মধ্যে চীনের প্রেসিডেন্টকেও আনা হলো। এই সরকার ভারতের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল থাকার পরেও চীনের প্রেসিডেন্টের আগমনে এই সরকারের বিশেষ স্বাধীনতা প্রকাশ পেয়েছে। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরে চীনকে আসতে দেয়া হয়নি। চীনও বাংলাদেশের মাঠকে ফাঁকা রাখতে চায় না। এর মধ্যে দিয়ে বলয় পরিবর্তন হচ্ছে ব্যাপারটা আসলে তা নয়, যার প্রমাণ পেয়েছি ভারতের গোয়ায় আলোচনা থেকে।
 
আবার রাষ্ট্রের মধ্যে যারা প্রতিযোগী তাদেরও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বশে আনতে সক্ষম হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন অনেক বাড়িয়ে দেয় হলো, সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রশাসনকেও ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলো। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলো পুরোপুরি আনুগত্যে না থাকলেও তাদের থেকে এক প্রকার ঝুঁকিটা কমিয়ে ফেলা হয়েছে।

Zillur

জাগো নিউজ : এটি একটি রাজনৈতিক দলের জন্য সফলতাও বটে?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : অবশ্যই। তবে সেটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আদর্শগত কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে নয়।

জাগো নিউজ : এমন সক্ষমতা অর্জনই তো প্রতিটি রাজনৈতিক দলের আদর্শ?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : রাষ্ট্রীয় শক্তিকে ব্যবহার করে বিরোধী দলকে নির্মূল করা কোনো রাজনৈতিক আদর্শ হতে পারে না। বিরোধীদের পক্ষ থেকে চ্যালেঞ্জ তৈরির জায়গাটা দুর্বল করে রাখতে পারছে সরকার। তবে এত কিছুর পরেও সরকারের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা দিতে পারেনি বলে, ঝুঁকিটা সামাল দিতে পারলেও সমাজে তেমন কোনো আনুগত্য তৈরি করতে পারেনি।

জাগো নিউজ : সরকারের রাজনৈতিক সক্ষমতার কথা বলছেন। এক সময় তো সুশাসনও গুরুত্ব পেতে পারে, যার মধ্য দিয়ে আনুগত্য আসতেই পারে?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : সুশাসন প্রতিষ্ঠা হতে পারে কিনা, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। আপাতত আশ্বস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর যদি সরকার সুশাসন দিতেই পারে, তাহলে তো রাজনৈতিক প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি না করার কোনো কারণ নেই। আনুগত্যের ভিত্তিতেই তারা ফের ক্ষমতায় আসতেই পারে। রাজনৈতিক সক্ষমতা দেখালেই সুশাসন, উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের জন্য দরজা খুলে যায় না। সরকারের দুর্বলতা মূলত এখানেই। আর এ কারণেই সরকার অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে ভয় পাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের গেল সম্মেলনেও এ দিকটি ফুটে উঠেছে। তারা যে একতরফা নির্বাচন করতে চায় এবং এর জন্য বিশেষ আয়োজন দরকার মূলত তারই মহড়া ছিল এই সম্মেলনে। মূলত আশঙ্কা থেকেই শক্তির এই মহড়া। এই সম্মেলনে নতুন কোনো পলিসি নেয়া হয়েছে ব্যাপারটি তা নয়। তারা বোঝাতে চেয়েছে, আমরা ঢাকাকে রঙিন করতে পারি, অচল করে দিতে পারি, সবই করার ক্ষমতা আছে আমাদের।

জাগো নিউজ : কিন্তু এই সম্মেলন নিয়েও তো দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ছিল।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : প্রতিটি দলেরই নিজস্ব ভোটব্যাংক আছে। কিন্তু এই ভোটব্যাংক ক্ষমতায় বসানো এবং নামানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে না। ভূমিকা রাখে সাধারণ ভোটার, যারা বিশেষ কোনো দলের আনুগত্য করে না। সরকার এই সাধারণ ভোটারদের আনুগত্যে আনতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করি না। সুষ্ঠু নির্বাচনের ঝুঁকিটা এখানেই।

আবার নেতৃত্বের একক কর্তৃত্বে দলের মধ্যেও যে খুব বেশি আনুগত্য আছে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। দলে সুশাসন নেই বলেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মধ্যে এত বিশৃঙ্খলা দেখতে পেলাম।

তবে হ্যাঁ, কথিত উন্নয়নের সুবিধা যদি বিতরণের মধ্য দিয়ে দলের মধ্যেকার ক্ষোভ ধামাচাপা দেয়া যেতে পারে, তাহলে ক্ষমতাসীনরা কিছুদিনের জন্য সুবিধা পেতে পারে।

Zillur

জাগো নিউজ : এই প্রশ্নে বিরোধীদের পক্ষ থেকে কোনো ঝুঁকিই নেই?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : সরকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিরোধীদের দমিয়ে রাখতে পারছে বটে। কিন্তু বিরোধীদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি।

অর্থাৎ সুযোগ পেলে সাধারণ বিরোধীরা প্রকৃত বিরোধী শিবিরে ভরসা রাখতেই পারে। এর আগে আমরা তাই দেখেছি।
বিরোধীদের একটি সফলতা হচ্ছে, এত কিছুর পরেও তারা বিলীন হয়ে যায়নি। বিরোধী জোট টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করেই টিকে আছে। আর এই টিকে থাকাকেই সরকার ঝুঁকি মনে করছে।

জন দাবি পূরণে ব্যর্থ হলেও খুব কৌশলে টিকে থাকার পথ অবলম্বন করেই চলছে বিরোধীরা। তারা মনে করে, সরকার ব্যর্থ হলে আর তো কোনো বিকল্প নেই। সুযোগ পেলে তারাই ক্ষমতায় আসবে।

খালেদা জিয়ার একমাত্র সফলতা হচ্ছে, বিএনপি টিকে আছে। বিলীন হয়ে যায়নি। টিকে থাকার মধ্য দিয়েই তারা সুযোগের অপেক্ষায় আছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যেখানে সুযোগ পেয়েছে, সেখানেই বিএনপি ভালো ফল করেছে।

এএসএস/এআরএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।