রাষ্ট্রে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার বাস্তবতা তৈরি হয়েছে


প্রকাশিত: ০৬:৪৩ এএম, ১০ নভেম্বর ২০১৬

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ। নির্বাহী সভাপতি-পিপিআরসি (পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার)। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। অর্থনীতি, উন্নয়ন, রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেন রামপাল ইস্যুতে। সঙ্গে ছিলেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। তিন পর্বের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথম পর্ব

জাগো নিউজ : সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ক্ষমতাসীন দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে উন্নয়নের বিষয়টিকেই অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে- এমনটিই প্রচারে-প্রকাশনায় তুলে ধরা হলো। উন্নয়নের বিষয়টি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : উন্নয়ন নিয়ে বিতর্ক প্রতিটি দেশেই আছে। উন্নয়ন বনাম গণতন্ত্র বিতর্ক এখন গোটা বিশ্বেই। সরকার উন্নয়নকে যেভাবে দেখানোর চেষ্টা করছে, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। গণতন্ত্রের প্রশ্নে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এক ধরনের বৈধতার ঘাটতি আছে। বৈধতার ঘাটতি ঢাকতেই সরকারের এমন কথিত উন্নয়ন তত্ত্ব। কোনো তথ্যের ভিত্তিতে এমন প্রচারণা ঠিক তা নয়, মূলত বৈধতার ঘাটতি চাপা দেয়ার জন্যই এভাবে বলা হচ্ছে।

insert

গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যই তো রাষ্ট্র, সমাজের উন্নয়ন। গণতন্ত্র না থাকলেও সরকার উন্নয়ন তত্ত্ব দিয়ে নিজেদের বৈধ করার চেষ্টা করছে। উন্নয়ন হচ্ছে কী অথবা আদৌ হবে কিনা- সেটা ভিন্ন বিষয় কিন্তু বৈধতার ঘাটতি উত্তরণের জন্য সরকারকে এমনটি বলতে হচ্ছে।

জাগো নিউজ : বৈধতার ঘাটতি আছে বলছেন, কিন্তু এর বিপরীতে তো ব্যাখ্যা আছে?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : হ্যাঁ, সরকারের কাছে এক ধরনের ব্যাখ্যা আছে। তারা বোঝাতে চায়, বিরোধী দল নির্বাচনে না এলে তাদেরই বা কী করার আছে। সাংবিধানিক বিধি রক্ষার জন্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প ছিলো না। ভালো কথা। কিন্তু সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও তার বক্তব্যে বলেছেন, পরবর্তী নির্বাচন যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। বৈধতার ঘাটতি আছে, তা সরকারের মধ্যেও যেমন এক ধরনের স্বীকারোক্তি আছে, তেমনি বিদেশিরাও বলছেন। বিরোধী জোট তো বলছেই।

বৈধতার ঘাটতি আরো গভীর হয়েছে পরবর্তী নির্বাচনগুলোতেও। সিটি নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, পৌর নির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন- সবই প্রমাণ করে, গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাটাই একপাক্ষিক হয়ে গেছে। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবর্তে ম্যানেজ নির্বাচনের ধারা চলে এসেছে। মিডিয়া, সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে এটি আজ প্রমাণিত। অর্থাৎ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে তা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ম্যানেজ নির্বাচনের এক ধরনের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। এ কারণেই উন্নয়নের এই ব্যাখ্যা দরকার পড়েছে।

insert

জাগো নিউজ : বৈধতার ঘাটতি পূরণে উন্নয়ন, এর তো ইতিবাচক দিকও আছে?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : আপনি খোদ উন্নয়ন নিয়েই নানা প্রশ্ন তুলতে পারেন। আসলে কী ধরনের উন্নয়ন হচ্ছে, এটি নিয়েও ব্যাখ্যা আছে।

রাষ্ট্রে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। এই এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা ধরে রাখার জন্য সরকার ম্যানেজ নির্বাচনের কোনো বিকল্প দেখছে না। এ কারণে সরকার, দল পরিচালনার পাশাপাশি উন্নয়নের ধরনটাও এককেন্দ্রিক নীতিতে পরিণত হয়েছে।

দেখুন, উন্নয়নের নানা ইতিবাচক দিক অবশ্যই লক্ষ্য করার মতো। সামাজিক নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য অথবা প্রযুক্তির মতো খাতে এক ধরনের পরিবর্তন অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে, এসব পরিবর্তনও এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনে সাধিত হচ্ছে। যা হচ্ছে, তা মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থেই।

জাগো নিউজ : এশিয়ার কয়েকটি দেশ তো গণতন্ত্র বনাম উন্নয়ন ধারায় উন্নয়নকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তারা সফলও বটে?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : একটি সমাজে তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তন হয়। উন্নয়ন প্রক্রিয়া, গণতান্ত্রিক কাঠামো অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং সুশাসন। পরিবর্তনটাকে আপনি একটি ত্রিভূজের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। আপনি যখন চীন এবং সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দেবেন, গণতন্ত্রকে আপনি দুর্বল করে দেখতেই পারেন। কিন্তু অন্য দুটি খুবই শক্তিশালী। সুশাসন এবং উন্নয়ন প্রশ্নে তাদের জবাবদিহিতা এবং রাষ্ট্রের সক্ষমতা খুবই শক্তিশালী।

উন্নত বিশ্ব ওই তিনটিকে গুরুত্ব দিয়েই এগোচ্ছে। চীন, মালয়েশিয়ায় সুশাসনও আছে আবার উন্নয়ন কাঠামোও আছে। আবার অনেক রাষ্ট্রে উন্নয়নের একটি ধরন আছে, তবে সেখানে ঘাটতি আছে। কিন্তু এসব রাষ্ট্রে সুশাসনও নেই, প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতিও নেই।

insert

সুশাসন না থাকলে উন্নয়নে ঘাটতি অবধারিত হয়ে যায়। ফিলিপাইনের উদাহরণ এখানে স্পষ্ট। আবার দক্ষিণ কোরিয়ায় কিছুদিন গণতন্ত্রের ঘাটতি ছিলো। এখন কিন্তু সুশাসন, উন্নয়ন, গণতন্ত্র- তিনটি ধরেই তারা এগোচ্ছে। ভিয়েতনামে গণতন্ত্রের ঘাটতি আছে। কিন্তু সুশাসনের বিষয়টি আরেকটু নিশ্চিত করে তারা কিছুটা এগিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই মডেলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? গণতন্ত্র একেবারে অনুপস্থিত না থাকলেও খুবই দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির ঘাটতি খুবই পরিষ্কার এবং এর জন্য নতুন করে আর প্রমাণ খোঁজার দরকার নেই। বিগত নির্বাচনে পেশিশক্তির ব্যবহার, প্রশাসনকে রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করানো, নানামুখী চাপ সৃষ্টি করে রাজনীতির প্রতিযোগিতা অনেকটাই নির্বাসনে দেয়া হয়েছে।

একই প্রশ্ন সুশাসনেও। সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। থানা-পুলিশের কাছে রাজনৈতিক মামলার আলাদা একটি ক্যাটাগরি করা হয়েছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আইনশৃঙ্খলার বিষয়টা ‘হ্যান্ডেল’ করা খুবই জোরালো হয়ে গেছে।

পাবলিক প্রসিকিউটরদের ভূমিকা নিয়ে বিশ্লেষণ করুন, দেখবেন অন্যরকম তথ্য বেরিয়ে আসবে। পুলিশ প্রশাসনের সদস্যরা বিরোধী দলকে দমন করতে একেবারে রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নামছে। এই বিষয়গুলো থেকে আপনি রাষ্ট্রের চরিত্রের নমুনা সংগ্রহ করতেই পারেন।

এরপর আসছে দুর্নীতি। রাষ্ট্র, সরকার যেন নিজেই বৈধ দুর্নীতি করার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। অযৌক্তিক প্রকল্প ব্যয় করে দুর্নীতিকে বৈধ করা হচ্ছে। ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এই ২০ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমেই চলে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে এক কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে যে ব্যয় হয় তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হচ্ছে বাংলাদেশে।

এএসএস/এআরএস/এনএফ/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।