ভেঙে পড়েছে ঢাবির সাংস্কৃতিক বলয়


প্রকাশিত: ১০:১৮ এএম, ২৬ অক্টোবর ২০১৬

বাঙালি সংস্কৃতির চর্চার ধারক-বাহকের ভূমিকায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। পড়ালেখার পাশাপাশি কাঁপিয়েছেন মাঠ। মাতিয়েছেন মঞ্চও। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ছিল সংস্কৃতির চর্চার মূল কেন্দ্র। যাবতীয় শিল্প চর্চায় মুখর ছিল পুরো ক্যাম্পাস। সাংস্কৃতিক আন্দোলন দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা ও জাতীয়তাবাদের সঠিক পরিচয় ফুটিয়ে তুলছেন অত্যন্ত সৃজনশীল ও শৈল্পিকভাবে।

তবে অতীতের সে গৌরব হারিয়ে ক্রমেই ফিকে হচ্ছে ঢাবির সে ঐতিহ্য।  টিএসসিতে সংগঠন বাড়লেও জমছে না আগের মতো। ডাকসু না থাকায় যেন অভিভাবকহীনভাবে চলছে শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম। এছাড়া অনেকটা ব্যবসানির্ভর হয়ে পড়েছে টিএসসির সংগঠনগুলো।   

জানা যায়, প্রতিষ্ঠার এক বছর পরই ঢাবিতে শুরু হয় সংস্কৃতির চর্চা। সে বছর জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রভোস্ট অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের রচনায় নাটক ‘আনন্দ-মন্দির’ মঞ্চস্থের মাধ্যমে যাত্রা শুরু। ১৯৩৩ সালে নাটকের সঙ্গে সংযোজন হয় নাচের। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্রদের উদ্যোগে মহুয়া নাটকের ‘মহুয়া’ চরিত্রে এ নাচ সংযোজন হয়।

১৯৫৪-৫৫ শিক্ষাবর্ষে ছাত্রদের কর্মকাণ্ডে আগ্রহী হয়ে প্রথমবারের মতো নাটকে অংশ নেন ছাত্রীরা। ১৯৪৭ সালে নারীরা অংশ নেন সংগীত চর্চায়। এরপরই সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ১৯৫৬ সালে গঠিত হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক সংসদ’। তখন থেকে নিয়মিতভাবে সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতার বিস্তৃতি। তবে ১৯৬১ সালে টিএসসি প্রতিষ্ঠার পর সাংস্কৃতিক চর্চা বেগবান হয়।  

তবে অতীতের সমৃদ্ধিকে পেছনে ফেলে এখন টাকা কামানোর ধান্দায় মজেছে টিএসসিকেন্দ্রিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য অর্জনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা বাড়লেও জমে না কার্যক্রম। টিএসসিকেন্দ্রিক শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনপ্রাপ্ত সংগঠন প্রায় ১৪টি। আরো ৪৫টির অধিক সংগঠন কাজ করে টিএসসি ঘিরে। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে কোর্স, রুম দখলের রাজনীতি, আন্তঃকোন্দলে প্রতিষ্ঠান সিলগালা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডহীনসহ নানা সমস্যায় এগুলো জর্জরিত।   

সংগঠনের আড়ালে রুম দখলের রাজনীতি এখন সবচেয়ে বেশি। টিএসসিতে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা ও রুম বরাদ্দ পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী হওয়ার শর্ত থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন।

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে রুম দখল করে নিয়েছে বেশ কয়েকটি সংগঠন। এর মধ্যে রয়েছে- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ, দৃষ্টি, স্লোগান-৭১, প্রভাতফেরি, পদাতিক নাট্য সংসদ, সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন এবং শ্রোত আবৃত্তি সংসদ।

এ সংগঠনগুলোর মধ্যে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন মাঝে মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে কর্মকাণ্ড চালালেও অন্য কোনো সংগঠনের দৃশ্যমান কোনো কর্মসূচি নজরে পড়ে না। বছরে একটা লোক দেখান অনুষ্ঠানে আবদ্ধ কয়েকটি সংগঠন। আবার কোনো কোনো সংগঠন তাদের রুম বছরে মাত্র একবার খোলে।   

তবে হল ও কেন্দ্রীয়ভাবে ডিবেটিং সোসাইটির কার্যক্রম বেশ সমৃদ্ধ। সর্বশেষ জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে এ সংগঠন। তবে এ সংগঠনটির নেতৃত্ব নির্বাচনে দীর্ঘদিন ধরেই অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

সংগঠনটির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ আরিফ হোসেন আশিকের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট এখানো কাজ করছে। ডিবেটিং সোসাইটির বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল কবির শয়ন সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের পদধারী নেতা ছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কার্যকরী কমিটির এক সদস্য বলেন, ডিবেটিং সোসাইটিকে রাজনীতিমুক্ত করতে না পারলে এ সংগঠনের গৌরব শুধু উজ্জ্বল ইতিহাসই বলতে হবে। নতুন বিতার্কিক তৈরি কঠিন হবে।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাফল্যের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম সোসাইটির রয়েছে আশানুরূপ শিল্পী তৈরি না করতে পারার ব্যর্থতা। বিভিন্ন প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেও তেমন কোনো ডুকুমেন্টারি নেই। অনুষ্ঠানের নামে অর্থ কামানোর ধান্দার অভিযোগও রয়েছে। এছাড়াও গত ৬ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের একটি অংশ জোর করে কমিটিও দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

DU   

আইটি সোসাইটির বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইমরান হোসেনের ছায়া নেতৃত্ব এখনো চলছে। ইমরানের বিরুদ্ধে সভাপতি থাকাকালীন দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে। বার্ষিক আইটি উৎসবের আড়ালে টাকা কামানোই তাদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আইটি বিষয়ক কোনো প্রোগ্রামের আয়োজনও লক্ষ্য করা যায় না। প্রায়ই অর্থের বিনিময়ে কোর্সের আয়োজন করে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি। তবে এ কোর্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর চেয়ে বহিরাগতদেরই উপস্থিতি বেশি।

দীর্ঘদিন ধরে আন্তঃকোন্দলে বন্ধ রয়েছে জয়ধ্বনি সাংস্কৃতিক সংসদ। দাবা ক্লাবের নেই কোনো কার্যক্রম। সাইকেলিং ক্লাব বছরে একটা র্যা লি করলেও ইনডোর গেমসের কার্যক্রম চোখে পড়ে না। সংগঠনগুলোরও কর্মকাণ্ড প্রত্যাশা অনুযায়ী নয় বলে মনে করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা।

তবে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ‘জহুরুল হক হল সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র’ ও অমর একুশে হলে ‘একুশে সাংস্কৃতিক ক্লাব’ নামে দুটি সংগঠন রয়েছে।

জানতে চাইলে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, টিএসসির সাংস্কৃতিক কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। ডাকসু ও হল ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে শৃঙ্খলা আসতো। সংস্কৃতির বিপ্লব হতো।

সার্বিক বিষয়ে টিএসসির পরিচালক মহিউজ্জামান চৌধুরী (ময়না) জাগো নিউজকে বলেন, রুম টিএসসি কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ দেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছ থেকে আগেই বরাদ্দ পেয়েছে। কোনো সংগঠনের কার্যক্রম না থাকলে রুম দখলের যৌক্তিকতা নেই। শিগগিরই একটা নাড়াচাড়া দেয়া হবে।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, রুম বরাদ্দ আগেই দেয়া হয়েছিল। তবে কার্যক্রম না চালালে নৈতিকভা্বেই রুম ছেড়ে দেওয়া উচিত।       

এমএইচ/এএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।