মানুষ রাষ্ট্র ও রাজনীতির ওপর আর ভরসা পাচ্ছে না
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছাড়াও সুন্দরবন রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক। সম্প্রতি সমাজ ও রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের। কথা বলেছেন নারী ও শিশু নির্যাতন এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েও। তিন পর্বে সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : নারীর মতো শিশুরাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারে ভয়ঙ্কর চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে। শিশুর প্রতি এই নির্যাতন কতটুকু ভাবায়?
সুলতানা কামাল : বিচারহীনতার কারণে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের যখন কোনো প্রতিকার হয় না, তখন সমাজের সর্বত্রই পচন ধরে। অন্যায় করলে পার পাওয়া যায় এবং রাজনীতি ও সমাজ সবলের পক্ষে অবস্থান নেয়- তখন এই অধঃপতন আর থামানো যায় না। অর্থাৎ অধীনস্তদের ওপর জুলুম করা যায়, এটি মানসিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ফলে দুর্বৃত্তরা তাদের দাপট দেখিয়েই যায়।
সম্প্রতি যে কজন শিশু ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারা কেউ-ই কিন্তু সমাজের উচ্চবিত্ত ঘরের নয়। প্রান্তিক অবস্থানে থাকা শিশুরাই এসব নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতনকারী জানেন, এই নির্যাতন করে তাকে কারও কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে না। ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’-এই নীতি আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এমনভাবেই গেড়ে বসেছে যে, অন্যায়কারী ভেবেই নেয় তাকে এই কর্মকাণ্ডের জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না।
জাগো নিউজ : বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্য রাজনীতিকে কতটুকু দায়ী করবেন?
সুলতানা কামাল : অবশ্যই রাজনীতি প্রধানত দায়ী। রাজনীতির যে আবহ রয়েছে, তা অন্যায়কে আরো উসকে দেয়। এমন রাজনীতি তাদের দেখতে হচ্ছে যে, নারায়ণগঞ্জে সেই নির্যাতিত শিক্ষক বলতে বাধ্য হচ্ছেন তার ওপর কোনো নির্যাতনই হয়নি। সেখানে সাত খুন, ত্বকি হত্যার কোনো বিচার এগোয় না। মিতু হত্যা, তনু হত্যার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। সম্প্রতি যে কয়টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তার কয়টির বিচার হয়েছে? নির্যাতনকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জাগো নিউজ : এর মানে রাজনীতি জনদায় থেকে সরে যাওয়ার কারণেই এমনটি হচ্ছে?
সুলতানা কামাল : রাজনীতি তো আর মানুষের স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে না। রাজনীতি এখন ব্যক্তি, দল বা পরিবারের স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে। কোনো একটি পরিবার বা ব্যক্তিকে রক্ষা করাই এখনকার রাজনীতি। জনগণের প্রতি রাজনীতিকদের আর দায় কাজ করে না বরং রাজনীতিকদের বাঁচানোই জনগণের দায় হয়ে গেছে। এ কারণেই মানুষ রাষ্ট্র ও রাজনীতির ওপর আর ভরসা পাচ্ছে না।
জাগো নিউজ : এরও তো একটি পরিসমাপ্তি আছে?
সুলতানা কামাল : ব্যক্তি বা পরিবার বিশেষ নয়, রাজনীতি জনগণের হাতে গেলেই মুক্তি মিলবে।
জাগো নিউজ : হত্যা ও গুমের প্রতিবাদে আপনারাও সরব। তবুও কেন থামছে না?
সুলতানা কামাল : বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেললে মানুষ ত্বরিত গতিতে সমাধান খোঁজে। রাষ্ট্রই এই ‘শর্টকাট’ শিখিয়ে দিচ্ছে। একদিকে রাষ্ট্র বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে জনগণও পিটিয়ে মারছে।
রাষ্ট্র মনে করছে, এই অপরাধীকে ছেড়ে দিলে সে আরো বড় অন্যায় করতে পারে। আবার জনগণ মনে করছে, অপরাধীকে ছেড়ে দিলে সে আইনের ফাঁক এবং ক্ষমতার জোরে বেরিয়ে এসে দ্বিগুণ অত্যাচার করতে পারে। উভয়েই নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থার ওপর রাষ্ট্র নিজেই আস্থা হারিয়ে ফেলার বার্তা দিচ্ছে। জনগণও হারিয়ে ফেলেছে।
এএসএস/আরএস/এবিএস