ভবিষ্যৎ ইঞ্জিনিয়ারদের বিনা পারিশ্রমিকে খাটাচ্ছে বাংলাদেশ বিমান


প্রকাশিত: ০৬:৫০ এএম, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

দিনে ৮ ঘণ্টা করে সপ্তাহে ৬ দিন অফিস। পাশাপাশি দুই দিন বাধ্যতামূলক নাইট ডিউটি। রোদবৃষ্টি, ঝড় যে পরিস্থিতিই থাকুক না কেন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিমানের লাইন কিংবা বেজ মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ট্রেনিং সেন্টারের (বিএটিসি) এভিয়েশনের শিক্ষার্থীরা। অথচ তারা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সর্বাধুনিক, যুগোপযুগী এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ারিং প্রশিক্ষণ ইউরোপিয়ান এভিয়েশন সেফটি এজেন্সি (ইয়াসা-১৪৭) কোর্স শেষ করে করে এখানে কাজ করতে এসেছেন।

দেশের একমাত্র সরকার অনুমোদিত বিএটিসির প্রথম ব্যাচের ৩২ জন শিক্ষার্থী বর্তমানে তারা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে বিনা পারিশ্রমিকে ‘ট্রেইনি’ হিসেবে কর্মরত আছেন।

শিক্ষার্থীরা জাগো নিউজকে বলেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হ্যাংগারের ভেতরের (তারা যেখানে কাজ করেন) পরিবেশ নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর। টয়লেটের পাশে একটি ম্যাক রুম নামে একটি দুর্গন্ধযুক্ত জরাজীর্ণ কক্ষে বিশ্রাম নেন তারা।

প্রায় ১০ বছর পর ২০১১ সালে ইয়াসা (ই.ইউ) অনুমোদন পেয়েই ২০১২ সালে ৩২ জন শিক্ষার্থী বাছাই করে নিয়ে আন্তর্জাতিক এই কোর্সটি শুরু করে বিএটিসি। সাড়ে ৪ বছর এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ারিং লাইসেন্স কোর্স শেষ করেই এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বিনা পারিশ্রমিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সঙ্গে যুক্ত হন তারা। সেখানে তাদের ‘ট্রেইনি’ পদে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, তাদের কর্মস্থলে পানি পান করার জন্য নেই কোনো গ্লাস। একটি কলের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতে হয়। মাসিক বেতন তো দূরের কথা, বলাকার পক্ষ থেকে সামান্য নাস্তা কিংবা গাড়ী ভাড়ার টাকাও পান না ভবিষ্যতের এই ইঞ্জিনিয়াররা।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানান, ‘অনেকেই প্রথম সারির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলোকিত ভবিষ্যতের জন্য এই কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। কোর্স শেষ হতে তো এমনিই দেরি হয়েছে, এতদূর আসার পর কোন টাকা ছাড়াই তারা খেটে যাচ্ছে বলাকার জন্য।’

শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চিফ ইঞ্জিনিয়ার (প্রোডাকশন) জাগো নিউজ বলেন, শিক্ষার্থীদের  বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য গতকাল (মঙ্গলবার) অনুষ্ঠিত বিমানের বোর্ড মিটিংয়ের এজেন্ডায় বিষয়গুলো ছিল। তবে সেখানে কি আলোচনা হয়েছে বা সমস্যা সমাধানে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা আমার জানা নেই।

আগামীর এই ইঞ্জিনিয়ারদের ভবিষ্যৎ কি? জানতে চাইলে বিমান এয়ারলাইন্স ট্রেনিং সেন্টারের (বিএটিসি) প্রিন্সিপাল ড. পার্থ কুমার পন্ডিত জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ট্রেনিং করানোর কমিটমেন্ট হয়েছে। আমরা তাদের ট্রেনিং করিয়েছি। এর চেয়ে আর বেশি কি করতে পারি বলেন?

Biman

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স প্রায়ই চুক্তির ভিত্তিতে ১৫-১৬ লাখ টাকা বেতন দিয়ে দেশের বাইরে থেকে ইয়াসা লাইসেন্সধারী চুক্তিভিত্তিক ইঞ্জিনিয়ার আনে। কিন্তু বাংলাদেশে একই কোর্স করা ছেলেদের প্রতি বিন্দু পরিমাণ নজর নেই তাদের।

বিএটিসির এসব শিক্ষার্থীরা দেশের বেসরকারি যেকোন এয়ারলাইন্সে ট্রেইনি ইঞ্জিনিয়ার পদে প্রায় ৫০-৬০ হাজার টাকা মসিক বেতনে কাজ করতে পারেন। তবে এই ইঞ্জিনিয়াররা বড় উড়োজাহাজের সিলেবাসে পারদর্শী বলে তারা বিমান বাংলাদেশের সঙ্গেই কাজ করতে চায়। কারণ বিমান বাংলাদেশের কাছেই রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উড়োজাহাজগুলো।

এসব ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মস্থলে কেন এত অবহেলা? কাজের বিনিময়ে কেন টাকা পাচ্ছেন না? জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, বিমান কর্মকর্তাদের দূরদর্শিতার অভাব ও পুরনো শোষণ মানসিকতার কারণেই শিক্ষার্থীদের আজ এই দশা।

এ বিষয়ে বিমানের ইন্সপেকশন ও কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার অফিসার (অ্যাভিওনিক্স) মো. এনামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না।

সিভিল এভিয়েশন ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার অনেক চেষ্টা করেও তাদের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

যে কারণে বিদেশি এয়ারলাইন্সে চাকরি করতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা : ২০১১ সালে বিএটিসিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম ঠিক করা হয়েছিল বিমান ইউনিভার্সিটি অব এভিয়েশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (বিইউএই)। সরকারি যাচাই-বাছাই শেষে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার জন্য ২০১৩ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর শিডিউলও পেয়ে গিয়েছিল সেন্টারটি। বিইউএই হতো এশিয়ার প্রথম এবং বিশ্বের চতুর্থ ইয়াসা অনুমোদিত এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয়। তবে ‘অজানা’ কারণে সেই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী অংশগ্রহণ করেননি, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণাও আসেনি।

বিএটিসির ইয়াসা-১৪৭ কোর্সকে ৮০ ক্রেডিট দেওয়া যাবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তবে একজন শিক্ষার্থীর গ্র্যাজুয়েট বা স্নাতক পাশ করতে ১৩৫ ক্রেডিট প্রয়োজন। আর বিশ্ববিদ্যালয় না হওয়ায় বিএটিসির শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েটরা এই ৫৫ ক্রেডিটের কোর্স করতে পারছেন না। আর স্নাতকের মর্যাদা না থাকায় তারা অন্য এয়ারলাইন্সগুলোতে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারছেন না। সিভিল এভিয়েশন কিংবা বিমানের ম্যানেজমেন্ট চাকরির পথও বন্ধ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর হচ্ছে না যে কারণে : শিক্ষার্থীদের মতে, সিভিল এভিয়েশন এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা চান না যে, এই যুগের আধুনিক ছেলেমেয়েরা এই পেশায় এসে তাদের জায়গা দখল করুক, বিমানবন্দরকে ঢেলে উন্নত করুক।

বিমান বাহিনী, সিভিল এভিয়েশন, বিএটিসি (বিমান এয়ারলাইন্স) সমন্বিতভাবে বঙ্গবন্ধু ইউনিভার্সিটি অব এভিয়েশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। চূড়ান্ত হয় বিএটিসিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন ইন্সটিটিউট করার সিদ্ধান্ত। কিন্তু বর্তমানে এই প্রক্রিয়া থমকে আছে।

এআর/এআরএস/আরএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।