তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা


প্রকাশিত: ০৭:১৪ পিএম, ২৩ আগস্ট ২০১৬

ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। ফলে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ।

খেলাপি ঋণের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা (এপ্রিল-জুন`২০১৬) সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশেষ সুবিধায় বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়মিত করার পরও এ খাতে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। আর মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়া‌কে উদ্বেগজনক ম‌নে কর‌ছেন অর্থনী‌তি‌বিদ ও বি‌শ্লেষকরা। তা‌দের ম‌তে, এসব মন্দ ঋণের কারণে যেসব ব্যবসায়ী সৎভাবে ঋণ নিয়ে সময় মতো পরিশোধ করছে তারা নিরুৎসাহীত হবে। একই স‌ঙ্গে খেলা‌পি ঋণ সম্পর্কে এখনই সতর্ক ও সচেতন না হলে আগামী‌তে অনেক ব্যাংক তাদের অস্তিত্ব হারাবে।

চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময়ে দেশে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। গত তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বেড়েছিল প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, খেলাপি ঋণ বেশি হলে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার ক্ষমতা কমে যায়। ফলে সুদের হারও বাড়ে। বাংলাদেশে আমানতের সুদের হার কমিয়ে এসব সমন্বয় করা হচ্ছে। খেলাপিদের বিভিন্ন সুবিধা দেয়ার ফলে ভালো গ্রাহকদের কাছে খারাপ সংকেত যাচ্ছে।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য নীতিমালার আলোকে ২০১৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলোকে নতুন পদ্ধতিতে ঋণ শ্রেণিকরণ করতে হচ্ছে। এছাড়া ওই সময়ে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওই বছরের বেশিরভাগ সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। দুইয়ে মিলে ২০১৩ সাল শেষে ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ থেকে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশে ওঠে।

বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনা ও ব্যাংকগুলোর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে শিথিল শর্তে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সুবিধা নিয়ে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়। এ ছাড়া বৈশ্বিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে বেকায়দায় পড়া বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ সুবিধা নিয়ে ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছে।

এসব কারণে গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ তিন হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা কমে ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। তবে পুনঃতফসিল করা ঋণের একটি অংশ আবার খেলাপি হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিদর্শনে কিছু ঋণ নতুন করে খেলাপি করে দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিশেষ সুবিধায় পুনঃতফসিল করা ঋণের একটি অংশ আবার খেলাপি হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমায় অনেকে দাম বাড়ার আশায় ধরে রেখে যথাসময়ে ব্যাংকের টাকা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এর বাইরে শিপব্রেকিংসহ কিছু খাত সমস্যায় থাকায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তবে বছর শেষে এ পরিস্থিতি থাকবে না বলে তিনি মনে করেন।

এফবিসিসিআইর সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমেদ বলেন, সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এক ধরনের বিরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। অন্যদিকে দেশে জ্বালানি সরবরাহ ঠিক না থাকায় অনেকে সময়মতো পণ্য উৎপাদন করতে পারছেন না, এতে জাহাজীকরণ হচ্ছে দেরিতে। ফলে ডিসকাউন্ট হচ্ছে। এসব কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছেন।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৩০ হাজার ১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১০ দশমিক শূণ্য ৬ শতাংশ। মার্চে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এ হিসাবে তিন মাসে মোট ঋণ বিতরণ ৩১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা বা দুই দশমিক ৮০ শতাংশ বাড়লেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ঋণ খেলাপি হয়েছে সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে। এসব ব্যাংকের মোট ঋণের ২৬ দশমিক ১৪ শতাংশই হচ্ছে খেলাপি ঋণ। বিশেষায়িত দুই ব্যাংকে আগের প্রান্তিকের মতোই খেলাপি ঋণ রয়েছে পাঁচ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ৫টি ব্যাংকে (সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা ও বেসিক ব্যাংক) মোট ঋণের ২৫ দশমিক ৭৪ শতাংশই হচ্ছে খেলাপি ঋণ।

তিন মাসে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দুই হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা বেড়ে ৩০ হাজার ৭৬ কোটি টাকা হয়েছে, যা তাদের মোট ঋণের ২৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আগের প্রান্তিক শেষে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ২৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা বা ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ ছিল। এ ছাড়াও বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে মোট ঋণের পাঁচ দশমিক ৪৪ শতাংশ হচ্ছে খেলাপি ঋণ।

গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমেছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর। তিন মাসে এ খাতের খেলাপি ঋণ ১৬ কোটি টাকা কমে ২৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগে যেখানে মোট ঋণের পাঁচ দশমিক ৭৫ শতাংশ খেলাপি ছিল, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর বাংলাদেশে ব্যবসায়রত বিদেশি ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ হচ্ছে খেলাপি ঋণ। আর মার্চ থেকে জুন এই তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বিপুল পরিমাণ এ খেলাপি ঋণ দেশের জন্য অশনিসংকেত। কারণ, গত কয়েক বছরে যে ঋণ দেয়া হয়েছে, তা কখনোই আদায় হবে না। খেলাপি ঋণ আদায়ে আরো বেশি কঠোর হতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

এসআই/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।